১৪ জনের নাম ফাঁস করলেন সেই এনায়েত

পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক এনায়েত করিম (Enayet Karim)-কে ঘিরে প্রতারণা, ষড়যন্ত্র এবং রাজনৈতিক অস্থিরতায় জড়িত থাকার বিস্ফোরক তথ্য সামনে এসেছে। নিজেকে সিআইএ ও ‘র’-এর এজেন্ট পরিচয় দিয়ে যিনি এক সময় রাষ্ট্র ক্ষমতার মোহজালে রাজনৈতিক নেতাদের ঘায়েল করার মিশনে কাজ করেছেন, এখন তিনিই মুখ খুলে দিয়েছেন একে একে ১৪ জনের নাম।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের হেফাজতে রিমান্ডে থাকা এনায়েত করিম স্বীকার করেছেন, তার ‘সিআইএর দক্ষিণ এশিয়ার পরিচালক’ পরিচয়টি ছিল পুরোপুরি ভুয়া। তিনি আরও জানিয়েছেন, ২০১৪ সালে বিএনপি ভাঙার ‘অ্যাসাইনমেন্টে’ তিনি সরাসরি যুক্ত ছিলেন এবং এ কাজে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর (RAW) সাথে তৎকালীন ডিজিএফআই কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন।

জিজ্ঞাসাবাদে তিনি যে ১৪ জনের নাম প্রকাশ করেছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন রাজনৈতিক নেতা, সাবেক সরকারি কর্মকর্তা, সাংবাদিক এবং সংস্কৃতি অঙ্গনের পরিচিত মুখ। তারা সবাই তার সঙ্গে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের কাজে যুক্ত ছিলেন বা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখতেন বলে দাবি করেছেন এনায়েত।

নাম প্রকাশ পাওয়া ১৪ জন হলেন: জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের (GM Quader), আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাসিম, ডিজিএফআই-এর সাবেক মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) তাবরেজ শামস, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) সাইফুল আলম, সাবেক আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারি, জাতীয় পার্টির নেতা ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, কাজী মামুনুর রশীদ, বিএনপির সাবেক অফিস সম্পাদক মফিকুল হাসান তৃপ্তি, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর (Nurul Haque Nur), জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি ইশতিয়াক আজিক উলফাত, নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম, অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন (Ilias Kanchan), সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদ এবং সাখাওয়াত হোসেন বকুল।

জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তিনি এই ১৪ জনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতেন এবং অর্থ লেনদেন করতেন। কেউ কেউ তার হয়ে কাজ করতেন তৃতীয় পক্ষ হিসেবে। এমনকি ২০২৩ সালের মার্চে বনানীর শেরাটন হোটেলে ইনসাফ কায়েম কমিটির সভার পুরো খরচও এনায়েত বহন করেন।

২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনের সময়গুলোতে এনায়েত বাংলাদেশে সক্রিয় ছিলেন। তিনি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে নানা মহলে বিনিয়োগ করে মোটা অংকের অর্থ উপার্জন করেছেন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের এক বছর পূর্তিতে আবারও তিনি বাংলাদেশে এসে সক্রিয় হন। সেসময় থেকেই আবার নানা চক্রান্তে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা শুরু করেন।

নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর মতে, এনায়েত একটি নতুন ‘ওয়ান-ইলেভেন’ ধাঁচের সরকার গঠনের ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকতে পারেন। তার বিরুদ্ধে তোলা অন্যতম বড় অভিযোগ—ভুয়া পরিচয়ে প্রতারণার মাধ্যমে রাজনৈতিক, ব্যবসায়ী ও আমলাদের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করা এবং প্রচুর অর্থ আত্মসাৎ করা।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, এনায়েত খুবই চতুর প্রকৃতির এবং জিজ্ঞাসাবাদের সময় প্রকৃত তথ্য গোপন রাখার চেষ্টা করছেন। তবু ধাপে ধাপে বেরিয়ে আসছে তার অতীত অপকর্ম। তার সিআইএর পরিচয়টি ছিল পুরোপুরি সাজানো। নিজেই তৈরি করতেন ভুয়া ডকুমেন্ট, যা স্ক্যান করে মোবাইলে পাঠাতেন বিভিন্নজনকে।

ডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসানোর প্রতিশ্রুতি, প্রেসিডেন্সিয়াল ডিনারে আমন্ত্রণ পাইয়ে দেওয়ার প্রলোভন দিয়ে বহু মানুষের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করেছেন।

এনায়েত ১৯৮৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং ২০০৪ সালে মার্কিন পাসপোর্ট পান। সর্বশেষ ২০২৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক থেকে ঢাকায় আসেন। এরপর সোনারগাঁও হোটেল ও গুলশানের একটি ফ্ল্যাটে অবস্থান নেন। তিনি দাবি করেছেন, তার ফ্লোরিডায় ফ্ল্যাট রয়েছে যেখানে পরিবার নিয়ে থাকেন, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তিনি কী কাজ করেন সে প্রশ্নে তিনি নিরুত্তর থাকেন।

গত ১৩ সেপ্টেম্বর মিন্টো রোড এলাকায় সন্দেহজনকভাবে গাড়ি নিয়ে ঘোরাঘুরির সময় পুলিশের হাতে আটক হন এনায়েত। নিজেকে তখন সিআইএর পরিচালক দাবি করেন। পরবর্তীতে ডিবি পুলিশ তাকে এবং তার সহযোগী এস এম গোলাম মোস্তফাকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করে। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত (Chief Metropolitan Magistrate Court) পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

ডিবি অফিসে রিমান্ডে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। রমনা বিভাগের ডিসি ইলিয়াস কবীর বলেন, “এনায়েত বড় মাপের প্রতারক, তাকে আমরা গভীরভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করছি।”

যেসব ব্যক্তির নাম এসেছে তাদের প্রতিক্রিয়াও এসেছে ভিন্ন ভিন্ন রকম। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ফোন কেটে দেন, এরপর আর ফোন ধরেননি। ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ জানান, একবার সোনারগাঁও হোটেলে এনায়েতের সঙ্গে দেখা হলেও তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। শওকত মাহমুদ বলেন, এনায়েত তাদের ফাইন্যান্স করেননি। মফিকুল হাসান তৃপ্তি বলেন, তিনি এনায়েত করিমকে চেনেন না, কখনো দেখাও হয়নি। সাংবাদিক লিটন এরশাদ জানান, ইলিয়াস কাঞ্চনের সঙ্গে এনায়েতের কোনো পরিচয় ছিল না।

এনায়েত জানান, তিনি কোনো ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা লেনদেন করতেন না। দেশে ও বিদেশে অর্থ আদান-প্রদানে তার পরিচিতদের ব্যবহার করতেন। তার সহযোগী গোলাম আজাদ মোস্তফা ছিলেন একাত্তর টিভির জিএম (অপারেশন)। ৫ আগস্টের পর তিনি চাকরি ছেড়ে এনায়েতের অধীনে ২ লাখ টাকা বেতনে সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। তার মাধ্যমেই টাকা বিভিন্ন জায়গায় পাঠাতেন এনায়েত।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ১৪ জনের সবাইকে প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে, তবে কাউকে অযথা হয়রানি করা হবে না। কারো সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে নেওয়া হবে আইনগত ব্যবস্থা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *