জুলাই সনদের চূড়ান্ত রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে

দীর্ঘ সংলাপ ও মতবিনিময়ের পর জাতীয় ঐকমত্য কমিশন (National Consensus Commission) মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ (July National Charter 2025)-এর চূড়ান্ত ভাষ্য পাঠিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষিত এই কমিশন জানায়, ১৭ অক্টোবর জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে, যেখানে ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা অংশ নেবেন।

সাত দফা অঙ্গীকারনামা ও মূল বৈশিষ্ট্য

চূড়ান্ত ভাষ্যে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব ও সাত দফা অঙ্গীকারনামা। সনদের তৃতীয় ধারায় বলা হয়েছে—সনদের বৈধতা বা প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনো আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করবে না রাজনৈতিক দলগুলো। শেষ ধারায় বলা হয়েছে—ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য সিদ্ধান্তগুলো দ্রুততম সময়ে বাস্তবায়ন করবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার (Interim Government)

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন স্পষ্ট করেছে, এবার নতুন করে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে মতামত নেওয়া হবে না। গত ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত দুই ধাপের আলোচনার মাধ্যমে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্য ও ভিন্নমত চিহ্নিত করা হয়, যা ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে এই চূড়ান্ত সনদ তৈরিতে।

ঐকমত্য ও ভিন্নমতের প্রস্তাবসমূহ

চূড়ান্ত খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী পদে একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন—এই প্রস্তাবে সব দল একমত হয়েছে। এছাড়া বিএনপি (BNP), জামায়াতে ইসলামী (Jamaat-e-Islami) এবং এনসিপি (NCP)-সহ ৩১টি রাজনৈতিক দল সংসদের ডেপুটি স্পিকারকে বিরোধী দল থেকে মনোনীত করার পক্ষে মত দিয়েছে।

রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি, সুপ্রিম কোর্ট বিকেন্দ্রীকরণ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের ক্ষেত্রেও ঐকমত্য দেখা গেছে অধিকাংশ দলের মধ্যে।

অন্যদিকে, সংবিধান বিলুপ্তি বা স্থগিত করণের বিষয়ে গণফোরাম (Gono Forum)বাংলাদেশ জাসদ (Bangladesh JASAD)-সহ তিনটি দল ভিন্নমত দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী একাধিক পদে থাকার বিধান নিয়েও ভিন্নমত প্রকাশ করেছে বিএনপি ও আরও কয়েকটি দল। সংসদে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন নিয়েও দলগুলোর মধ্যে বিভাজন রয়ে গেছে।

অঙ্গীকারনামার মূল বিষয়

চূড়ান্ত ভাষ্যে অন্তর্ভুক্ত অঙ্গীকারনামায় বলা হয়েছে—২০২৪ সালের জুলাই-অগাস্টের গণঅভ্যুত্থানে জনগণের রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত গণতান্ত্রিক সুযোগের প্রতিফলন হিসেবেই এই সনদ প্রণয়ন করা হয়েছে। এতে জনগণের ইচ্ছাকে সর্বোচ্চ আইন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

অঙ্গীকারনামার পঞ্চম ধারায় ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের বিচার, শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও আহতদের পুনর্বাসনের অঙ্গীকার করা হয়েছে। ষষ্ঠ ধারায় বলা হয়েছে—সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থার সংস্কারে প্রয়োজনীয় আইন সংশোধন ও নতুন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

সনদের পটভূমি ও ভাষাগত পরিবর্তন

চূড়ান্ত ভাষ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের পটভূমিতে নতুন কিছু সংশোধন আনা হয়েছে।
১৯৭৬ সালের বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার বছর সংশোধন করে লেখা হয়েছে—“১৯৭৮ সালে বহুদলীয় রাজনীতির পুনঃপ্রবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণের ফলে ১৯৭৯ সালে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।”
এছাড়া ২০০৬ সালের রাজনৈতিক সহিংসতার অংশে যোগ করা হয়েছে—“আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে লগি-বৈঠা তাণ্ডবে কয়েকটি নৃশংস রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়, যার পর ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারি হয়ে ১/১১ সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।”

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ণনায় সংশোধন করে লেখা হয়েছে—“সহস্রাধিক নাগরিক নিহত হয় এবং জনগণের সম্মিলিত শক্তির মুখে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ও তাঁর সহযোগীরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।”

স্বাক্ষর অনুষ্ঠান ও প্রস্তুতি

সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়। অনুষ্ঠানে প্রায় তিন হাজার অতিথিকে আমন্ত্রণ জানানোর পরিকল্পনা রয়েছে। মাগরিবের নামাজের আগে অনুষ্ঠিত হবে প্রথম পর্বের আনুষ্ঠানিক স্বাক্ষর অনুষ্ঠান এবং দ্বিতীয় পর্বে প্রজেকশন ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে জুলাই সনদ প্রণয়নের ইতিহাস প্রদর্শন করা হবে।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় মঞ্চ নির্মাণ শুরু করেছে। অনুষ্ঠানের সাংস্কৃতিক অংশের পরিকল্পনা করছেন উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী (Mostofa Sarwar Farooki), যিনি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস (Dr. Muhammad Yunus)-এর সঙ্গে বৈঠকের পর চূড়ান্ত অনুমোদন দেবেন।

কমিশনের মন্তব্য

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, “সব দলের কাছে সনদ পাঠানো হয়েছে। শুক্রবার ঐতিহাসিক মুহূর্তে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সনদ স্বাক্ষর হবে। আমরা আশাবাদী, এই সনদ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কারে নতুন অধ্যায় রচনা করবে।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *