রাষ্ট্রীয় কাঠামো, সংবিধান সংস্কার, বিচারব্যবস্থা, পুলিশি সংস্কার থেকে শুরু করে প্রশাসনিক পুনর্গঠন—সব মিলিয়ে ৮৪ দফার জুলাই জাতীয় সনদ চূড়ান্ত করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন (National Consensus Commission)। এই সনদের মাধ্যমে ৩২টি রাজনৈতিক দল ও জোট রাষ্ট্রীয় সংস্কারের ১৭টি বিষয়ে পূর্ণ ঐকমত্যে পৌঁছেছে; তবে বাকি ৬৭টি প্রস্তাবে কেউ কেউ বিরোধিতা করে দিয়েছে ‘নোট অব ডিসেন্ট’।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ (Ali Riaz)-এর স্বাক্ষরিত একটি চিঠির মাধ্যমে এই চূড়ান্ত সনদ পাঠানো হয় ৩৩টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছে। আসছে শুক্রবার জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় আনুষ্ঠানিকভাবে এই সনদে স্বাক্ষর হবে—অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইতোমধ্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে এই ঐতিহাসিক আয়োজনে।
সংবিধান সংশোধন ও নির্বাহী সংস্কার—দুই পথেই রাষ্ট্রীয় পুনর্গঠন
ঐকমত্য কমিশন জানিয়েছে, জুলাই সনদের ৮৪ দফার মধ্যে ৪৭টি সংস্কার কার্যকর হবে ‘সংবিধান সংশোধন’-এর মাধ্যমে, আর বাকি ৩৭টি ‘আইন, অধ্যাদেশ, বিধি বা নির্বাহী আদেশ’-এর মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে।
চূড়ান্ত ৪০ পৃষ্ঠার এই সনদে শুধু সংস্কার তালিকাই নয়, এতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে কমিশনের কার্যক্রম, পটভূমি এবং প্রতিটি রাজনৈতিক দলের অঙ্গীকার। প্রতিটি দফার শেষে রাখা হয়েছে দলগুলোর স্বাক্ষরের জায়গা।
সনদের শুরুতে রাজনৈতিক দলগুলো ঘোষণা দিয়েছে—
“আমরা বিদ্যমান শাসন ব্যবস্থা তথা সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশি ব্যবস্থা ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের ব্যাপারে ঐকমত্যে উপনীত হয়েছি। ২০০৯ সাল পরবর্তী ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এই সনদকে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ নামে ঘোষণা করছি।”
যেসব ইস্যুতে ঐকমত্য
প্রধানমন্ত্রী পদের মেয়াদসীমা, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি, নারী প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি, কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাঠামো—এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল একক অবস্থানে পৌঁছেছে।
সনদের চূড়ান্ত খসড়ায় বলা হয়েছে—
– একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন, এই প্রস্তাবে ৩০টি রাজনৈতিক দল ও জোটের ঐকমত্য হয়েছে।
– ডেপুটি স্পিকারকে বিরোধী দল থেকে মনোনীত করার পক্ষে বিএনপি, জামায়াতসহ ৩১টি রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে।
– অর্থবিল ও আস্থা ভোট বাদে দলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার স্বাধীনতার পক্ষে মত দিয়েছে বিএনপি-জামায়াত-এনসিপিসহ ৩০টি দল।
– সুপ্রিম কোর্টের বিকেন্দ্রীকরণে বিএনপির সামান্য মতভেদ থাকলেও ২৯টি রাজনৈতিক দল ও জোট সম্মতি জানিয়েছে।
– রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি নিয়েও ২৯টি রাজনৈতিক দল ও জোট, যার মধ্যে বিএনপি-জামায়াতও রয়েছে, ঐকমত্যে পৌঁছেছে।
– রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব নির্ধারণে সংবিধান সংশোধনের পক্ষে ৩০টি দল একমত হলেও ৯টি দল ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে।
– তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়েও বিএনপি-জামায়াতসহ ৩০টি রাজনৈতিক দল ও জোটের মধ্যে ঐকমত্য গড়ে উঠেছে।
– আর নারী প্রতিনিধিত্ব ক্রমান্বয়ে ১০০ আসনে উন্নীত করার প্রস্তাবে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপিসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দলই একমত হয়েছে।
যেখানে রয়ে গেছে ভিন্নমত
জুলাই সনদের ৬টি সংস্কার কমিশনের ৮৪টি প্রস্তাবের মধ্যেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দলের অবস্থানে পার্থক্য রয়েছে।
– সংবিধান বিলুপ্তি ও স্থগিতকরণ অপরাধ হিসেবে রাখার প্রস্তাবে ২৯টি দল একমত, তবে গণফোরাম, বাংলাদেশ জাসদসহ তিনটি দল দিয়েছে ভিন্নমত।
– প্রধানমন্ত্রী যেন দলীয় প্রধান বা সংসদ প্রধানসহ একাধিক পদে না থাকতে পারেন, এই বিধানে ২৫টি দল সমর্থন জানালেও বিএনপিসহ ৫টি রাজনৈতিক দল ও জোট দ্বিমত জানিয়েছে।
– উচ্চকক্ষ গঠনে সংখ্যানুপাতিক (PR) পদ্ধতি নিয়েও মতভেদ থেকে গেছে। জামায়াত ও এনসিপিসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ও জোট পিআর পদ্ধতির পক্ষে একমত হলেও বিএনপি ও এর বেশ কিছু শরিক দল এ বিষয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে।
সংবিধান সংস্কারের প্রস্তাবসমূহ
জুলাই সনদে প্রস্তাবিত গুরুত্বপূর্ণ সংবিধান সংশোধনের মধ্যে রয়েছে—বাংলার পাশাপাশি অন্যান্য ভাষার স্বীকৃতি, নাগরিক পরিচয়ের সংজ্ঞা পুনর্নির্ধারণ, সংবিধান বিলুপ্তি বা স্থগিতকরণের অপরাধ সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ বাতিল, এবং জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিধানে সংশোধন।
রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং ধর্মীয় সম্প্রীতি’কে নতুন রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষের গোপন ভোটের প্রস্তাব, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদানের আগে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মতামত নেওয়ার বাধ্যবাধকতা, এবং অভিশংসন প্রক্রিয়ায় সংশোধনের বিষয়ও এতে যুক্ত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও দ্বিকক্ষ আইনসভা নিয়ে মতভেদ
প্রধানমন্ত্রী পদের মেয়াদ সর্বোচ্চ ১০ বছর নির্ধারণ এবং দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রীর পদ পৃথক করার বিষয়ে ৩০টি দল একমত হলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ ও কাঠামো নিয়ে বেশ কয়েকটি দলের ভিন্নমত রয়েছে।
আইনসভা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করার প্রস্তাবে ২৫টি দল সম্মত হয়েছে, পাঁচটি দল দিয়েছে ‘নোট অব ডিসেন্ট’। নিম্নকক্ষের ভোটে উচ্চকক্ষ গঠনের প্রস্তাবে বিএনপি ও তার শরিকরা সহ নেশা কয়েকটি দল আপত্তি জানিয়েছে।
বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থার সংস্কার
জুলাই সনদে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে ‘স্বাধীন বিচার বিভাগীয় নিয়োগ কমিশন’ গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রধান বিচারপতি নিয়োগে জ্যেষ্ঠতা নীতি, সুপ্রিম কোর্টের বিকেন্দ্রিকরণ, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল শক্তিশালীকরণ, এবং অধস্তন আদালতের নিয়ন্ত্রণ সুপ্রিম কোর্টের হাতে দেওয়ার বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত।
নির্বাচন কমিশন গঠনে বাছাই কমিটি প্রক্রিয়ার বিধান, ন্যায়পাল নিয়োগ ও সরকারি কর্ম কমিশন পুনর্গঠনের প্রস্তাবও এতে রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনকে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান করার সুপারিশ করা হয়েছে।
নির্বাহী ও প্রশাসনিক সংস্কারের প্রস্তাব
‘আইন/অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়নযোগ্য’ অংশে রয়েছে—সংসদ সদস্যদের অধিকার ও দায় নির্ধারণে আইন প্রণয়ন, বিচারকদের আচরণবিধি, আদালত ব্যবস্থার ডিজিটাইজেশন, আইনজীবীদের আচরণবিধি, স্বাধীন ফৌজদারি তদন্ত সার্ভিস গঠন, এবং বিচার বিভাগের জনবল বৃদ্ধি।
জনপ্রশাসন সংস্কারের লক্ষ্যে স্থায়ী জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ও তিনটি নতুন সরকারি কর্ম কমিশন—সাধারণ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য—গঠনের অঙ্গীকার রয়েছে।
এছাড়া নিরীক্ষা বিভাগকে হিসাব বিভাগ থেকে পৃথক করা, নিরীক্ষা আইন প্রণয়ন, এবং কুমিল্লা ও ফরিদপুর নামে দুটি নতুন প্রশাসনিক বিভাগ গঠনের কথাও উল্লেখ আছে।
স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের প্রস্তাব
জুলাই সনদে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের একটি হলো স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন। এতে বলা হয়েছে, পুলিশ বাহিনীর পেশাদারিত্ব, জবাবদিহিতা এবং জনবান্ধব সেবা নিশ্চিত করতে এই কমিশন কাজ করবে।
কমিশনের গঠনে থাকবেন আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি (চেয়ারম্যান), অবসরপ্রাপ্ত এডিশনাল আইজিপি (সদস্য সচিব), সংসদ নেতা ও বিরোধী নেতার প্রতিনিধি, স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের প্রতিনিধি, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, অবসরপ্রাপ্ত বিচারক বা অভিজ্ঞ আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মীসহ অন্তত দুইজন নারী সদস্য।
কমিশনের ক্ষমতা থাকবে—
– পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত ও শাস্তির সুপারিশ,
– বেআইনি প্রভাবমুক্তভাবে পুলিশ পরিচালনা নিশ্চিত করা,
– পুলিশের কর্মকাণ্ডে আইনানুগতা রক্ষায় নির্দেশনা প্রদান,
– প্রয়োজনে বিচার বিভাগীয় তদন্ত পরিচালনা করা।
সাত দফা অঙ্গীকারনামা: জুলাই সনদের চূড়ান্ত প্রতিশ্রুতি
সবশেষে রাজনৈতিক দলগুলো সাত দফা অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করবে। এতে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে—
– গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে অর্জিত জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন হিসেবে জুলাই সনদ সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন,
– সনদকে সংবিধানে সংযুক্তকরণ এবং আইনি সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ,
– ২০২৪ সালের গণআন্দোলনের শহীদদের বিচার ও পরিবারগুলোর পুনর্বাসন,
– এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাধ্যমে অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য সিদ্ধান্তগুলো দ্রুত কার্যকর করা।
এই অঙ্গীকারের মধ্য দিয়েই রাজনৈতিক দলগুলো ঘোষণার পথে—**‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ হবে নতুন রাষ্ট্রীয় পুনর্গঠনের সংবিধানিক ভিত্তি।