জুলাই জাতীয় সনদের বাস্তবায়নে প্রস্তাবিত গণভোটের সময় নির্ধারণ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে চরম মতবিরোধ তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দৃঢ় অবস্থানে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছেন বলে সূত্র জানাচ্ছে। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য ইসলামপন্থি দলগুলোর মধ্যে অবস্থানগত পার্থক্য রাজনৈতিক উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি (BNP) চায় আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের দিনেই গণভোট হোক। দলটির অভিযোগ, নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজন করা হলে সেটি হবে “নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র”। স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দলটির নেতারা একযোগে এই অবস্থানকে সমর্থন জানিয়েছেন। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, “জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের একটাই উদ্দেশ্য—নির্বাচন বিলম্বিত করা।”
অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামী (Jamaat-e-Islami) ও এনসিপিসহ ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো গণভোটকে জাতীয় নির্বাচনের পূর্বশর্ত হিসেবে দেখছে। তাদের মতে, জনগণের অভিমত জানাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, “গণভোট আগে হলে মানুষের মধ্যে সচেতনতা আসবে, প্রতিফলিত হবে জনমত, আর সেটাই হবে পরবর্তী সংসদের ভিত্তি।”
সরকারের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো জানিয়েছে, ১৪ অক্টোবর মঙ্গলবার পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে ওঠেনি। এমনকি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন (National Consensus Commission) বা সরকারের পক্ষ থেকেও নির্দিষ্ট কোনও দিনক্ষণ নির্ধারণের ঘোষণা আসেনি। কমিশনের সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার জানিয়েছেন, “সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি, আলোচনা চলছে।” তবে তিনি আশাবাদী যে শুক্রবারের (১৭ অক্টোবর) মধ্যে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব।
তবে একটি বিষয় নিশ্চিত—গণভোটের সময় নির্ধারণ নিয়ে দুপক্ষেরই যুক্তি রয়েছে। নির্বাচনের আগেই ভোট হলে দলগুলো জনসচেতনতায় মনোযোগী হতে পারতো। কিন্তু নির্বাচন ও গণভোট একসঙ্গে হলে জুলাই সনদের গুরুত্ব কমে যেতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে, নির্বাচন কমিশনের একজন সদস্য বলেছেন, “কমিশন নির্বাচনের আগেই গণভোট পরিচালনা করতে পারবে কিনা, সেটাও একটি প্রশ্ন।” অপরদিকে, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না (Mahmudur Rahman Manna) মনে করেন, দুই-আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয় অতিরিক্ত নয়, এবং সরকার তা বহনে সক্ষম।
প্রসঙ্গত, এই বিতর্কের পেছনে একটি ধর্মভিত্তিক দলের রাজনৈতিক কৌশল কাজ করছে বলেও দাবি করেছেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের এক সদস্য। তাঁর মতে, নির্বাচনের তারিখ পেছালে ঐ দলের সুবিধা হতে পারে।
অন্যদিকে, ড. মুহাম্মদ ইউনূস (Dr. Muhammad Yunus) জাতিসংঘ সফর শেষে দেশে ফিরে সরকারের বিভিন্ন স্তরে অনেক বেশি প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন বলে বিএনপির এক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে। তার মতে, “যদি ড. ইউনূস প্রজ্ঞাপন জারি করেন, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলো সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে না।”
গণতন্ত্র মঞ্চ (Democracy Platform) ও গণসংহতি আন্দোলনের (Ganosamhati Andolon) নেতারাও গণভোটকে একটি জরুরি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া হিসেবে দেখছেন। জোনায়েদ সাকি বলেন, “যা কিছু করা উচিত, তা ঐকমত্যের ভিত্তিতে হওয়া উচিত।” অন্যদিকে মান্না বলেন, “ভোটের দিন গণভোট হলে এর স্পিরিট থাকবে না—এটা আমার ব্যক্তিগত মত।”
জামায়াতের মিয়া গোলাম পরওয়ার একে ‘জনস্বার্থ বনাম রাজনৈতিক ইগো’র দ্বন্দ্ব বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, একসাথে নির্বাচন ও গণভোট হলে যদি কিছু কেন্দ্রে সমস্যা হয়, তাহলে গণভোট অংশটি অনিশ্চয়তায় পড়বে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল মনে করেন, “গ্রেটার ইউনিটির স্বার্থেই আমরা নির্বাচনের দিন গণভোটে রাজি হয়েছি।” তবে তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন, যদি সরকারের সিদ্ধান্ত দলের অবস্থানের সঙ্গে না মেলে, তারা সেই গণভোটে অংশ নেবেন না।
অন্যদিকে, জামায়াতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, “এই আন্দোলন গঠনমূলক ও নিয়মতান্ত্রিক, এটি কোনও বিশৃঙ্খলা নয়।” তাদের দাবি, জনমত জানাই হচ্ছে মূল লক্ষ্য, এবং সরকার জনগণের বার্তা শুনুক।
শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) অনুষ্ঠেয় জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অন্তত ৩০টি রাজনৈতিক দল অংশ নেবে বলে জানা গেছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস-সহ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও উপস্থিত থাকবেন।
সামগ্রিক পরিস্থিতি রাজনৈতিক মেরুকরণের দিকে এগোচ্ছে। এখন দেখার বিষয়, ড. ইউনূস কি প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে এই বিতর্কের অবসান ঘটান, নাকি রাজনৈতিক শক্তিগুলোর ওপর আরও চাপ প্রয়োগ করেন।