চূড়ান্ত স্বাক্ষরের আগমুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ দুটি সংশোধন আনা হয়েছে ‘জুলাই জাতীয় সনদ–২০২৫’-এ। রাজনৈতিক আপত্তির মুখে সংবিধানের ১৫০(২) অনুচ্ছেদ এবং সংশ্লিষ্ট তফসিল সংক্রান্ত বিষয়ে এই পরিবর্তন আসে। এর ফলে সংবিধান থেকে বাদ পড়ছে না ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, যা নিয়ে চরম আপত্তি জানিয়েছিল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (Communist Party of Bangladesh – CPB) ও আরও তিনটি বামপন্থী দল।
গত ১৪ অক্টোবর, ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো অনুলিপিতে জানানো হয়েছিল, সংবিধানের ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলি বিষয়ক ১৫০(২) অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত হবে এবং পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম তফসিল সংবিধান থেকে বাদ দেওয়া হবে। এই সিদ্ধান্তে সম্মত হয়নি মোট ৯টি রাজনৈতিক দল।
এ অবস্থায় গতকাল বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দেয় বাসদ (BASAD), বাসদ (মার্ক্সবাদী), বাংলাদেশ জাসদ (Bangladesh JASAD) এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা। তাঁদের বক্তব্য ছিল, সংবিধান থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা বাদ দেওয়া হলে তা শুধু মুক্তিযুদ্ধ নয়, বাংলাদেশের অস্তিত্বকেও অস্বীকার করার শামিল।
তাঁদের আপত্তির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ১৫০(২) অনুচ্ছেদে উল্লেখিত ষষ্ঠ ও সপ্তম তফসিল। ষষ্ঠ তফসিলে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা এবং সপ্তম তফসিলে রয়েছে ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। তিনটি তফসিলই সংযোজিত হয়েছিল ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে।
চূড়ান্ত সংশোধিত সনদে এখন বলা হয়েছে, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫০(২) শুধুমাত্র সংশোধন করা হবে এবং পঞ্চম ও ষষ্ঠ তফসিল বাদ দেওয়া হবে, তবে সপ্তম তফসিল—অর্থাৎ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র—থাকছে। ফলে, ৭ মার্চের ভাষণ ও ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা বাদ গেলেও ১০ এপ্রিলের ঘোষণাপত্র থাকবে সংবিধানের অংশ হিসেবে।
অন্যদিকে, সনদের পঞ্চম দফায়ও আনা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন। আগে যেখানে শুধু ‘জুলাই শহীদদের’ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও সহায়তার কথা ছিল, সেখানে এখন আহতদের জন্যও রাষ্ট্রীয় বীরের স্বীকৃতি, সুচিকিৎসা, পুনর্বাসন এবং আইনগত দায়মুক্তির বিষয়টি সংযোজন করা হয়েছে।
আগের খসরায় লেখা ছিল:
“গণ-অভ্যুত্থানপূর্ব ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানকালে সংঘটিত সব হত্যাকাণ্ডের বিচার, শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান ও শহীদ পরিবারগুলোকে যথোপযুক্ত সহায়তা প্রদান এবং আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করব।”
নতুন ভাষ্যে আরও স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে:
“গণ-অভ্যুত্থানপূর্ব বাংলাদেশে ১৬ বছরের আওয়ামী ফ্যাসিবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানকালে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ (Awami League) ও তার সহযোগী আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত সব হত্যাকাণ্ডের বিচার, শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান, শহীদ পরিবারকে এবং আহতদের ‘জুলাই বীর যোদ্ধা’ হিসেবে মাসিক ভাতা, সুচিকিৎসা, পুনর্বাসন ব্যবস্থা, আইনগত দায়মুক্তি, মৌলিক অধিকার সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করব।”
এই পরিবর্তনগুলো শেষ মুহূর্তে আনায় সনদের গ্রহণযোগ্যতা কিছুটা হলেও বাড়তে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা। তবে, বাদ যাওয়া ভাষণ ও ঘোষণার বিষয় নিয়ে বিতর্ক এখনো বহাল।