জুলাই জাতীয় সনদের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে সামনে রেখে গুরুত্বপূর্ণ একধাপ এগোল জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) দুপুরে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস (Muhammad Yunus)-এর কাছে জাতীয় সনদ বাস্তবায়নসংক্রান্ত সুপারিশপত্র হস্তান্তর করে কমিশন, যার মধ্যে ৯টি সুপারিশ নির্বাহী আদেশে বাস্তবায়ন সম্ভব বলে মত দিয়েছে কমিশনেই সদস্যরা । সুপারিশপত্রটি প্রধান উপদেষ্টার হাতে তুলে দেন কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ (Ali Riaz)।
এই সময় উপস্থিত ছিলেন উপদেষ্টা পরিষদের অন্যান্য সদস্যসহ ঐকমত্য কমিশনের সদস্যবৃন্দ—বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ইফতেখারুজ্জামান, বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
সুপারিশপত্রে বলা হয়েছে, এগুলো নির্বাহী আদেশে বাস্তবায়নযোগ্য এবং তা করলে বিচার বিভাগ ও প্রশাসনিক কাঠামোতে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার নিশ্চিত হবে।
**নির্বাহী আদেশে বাস্তবায়নের উপযোগী ৯ দফা সুপারিশ
১. উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালতের সম্প্রসারণ:
সুপারিশ অনুযায়ী, জেলা সদরে অবস্থিত সদর উপজেলাগুলোর অধস্তন আদালতগুলোকে জেলা জজ কোর্টের অধীনে সুস্পষ্টভাবে সংযুক্ত করতে হবে। বিদ্যমান চৌকি আদালত, দ্বীপাঞ্চল এবং ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত উপজেলা আদালতগুলো বজায় রেখে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। জেলা সদরের নিকটবর্তী উপজেলাগুলোর ক্ষেত্রে নতুন আদালতের প্রয়োজন না থাকলেও, অন্য উপজেলার জনসংখ্যা, ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য ও যাতায়াতের দিক বিবেচনায় নতুন আদালত স্থাপনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া আইনগত সহায়তা কার্যক্রমকে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত সম্প্রসারণ এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করার সুপারিশ এসেছে।
২. বিচার বিভাগের জনবল বৃদ্ধি:
বিচারক ও সহায়ক জনবল বাড়ানোর পাশাপাশি বিশেষায়িত আদালত স্থাপনের কথা বলা হয়েছে যাতে বিচারিক প্রক্রিয়া আরও দক্ষ ও দ্রুত হয়।
৩. আদালত ব্যবস্থাপনায় ডিজিটাল সংস্কার:
মামলার দীর্ঘসূত্রতা, হয়রানি, খরচ কমানো এবং স্বচ্ছতা বাড়ানোর লক্ষ্যে আদালত ব্যবস্থাকে ডিজিটাইজ করার সুপারিশ এসেছে। এর জন্য প্রাসঙ্গিক বিধি প্রণয়ন ও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনার মাধ্যমে সংস্কার প্রক্রিয়া চালানোর কথা বলা হয়েছে।
৪. আইনজীবীদের আচরণবিধি যুগোপযোগী করা:
আইনজীবীদের জন্য নতুন আচরণবিধি তৈরি, জেলা পর্যায়ে বার কাউন্সিল ট্রাইব্যুনাল গঠন এবং এর প্রধান হিসেবে একজন বিচারকের দায়িত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি আদালত প্রাঙ্গণে দলীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করার সুপারিশও রয়েছে।
৫. স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন:
জুলাই গণ-আন্দোলনের সময় সংঘটিত গণহত্যা, নিপীড়ন এবং ভোট জালিয়াতির অভিযোগে জড়িত কর্মকর্তাদের চিহ্নিত ও বিচার নিশ্চিত করতে একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
৬. কুমিল্লা ও ফরিদপুর নামে নতুন দুই প্রশাসনিক বিভাগ:
ভৌগোলিক ও যাতায়াত সুবিধা বিবেচনায় কুমিল্লা ও ফরিদপুর নামে দুটি নতুন প্রশাসনিক বিভাগ গঠনের সুপারিশ এসেছে।
৭. দুর্নীতিবিরোধী জাতীয় কৌশলপত্র প্রণয়ন:
রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে একটি দুর্নীতিবিরোধী কৌশলপত্র তৈরি করে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নির্ধারণের পাশাপাশি সংবিধান অনুযায়ী একজন ন্যায়পাল নিয়োগ দিয়ে তার অধীনে কৌশলপত্র বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে।
৮. সরকারি সেবাখাতের অটোমেশন:
পুলিশ, রেজিস্ট্রি, রাজস্ব, পাসপোর্টসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও স্থানীয় প্রশাসনের সেবা কার্যক্রমকে সম্পূর্ণভাবে (এন্ড-টু-এন্ড) অটোমেশনের আওতায় আনার সুপারিশ করা হয়েছে।
৯. ওপেন গভর্নমেন্ট পার্টনারশিপে অংশগ্রহণ:
বাংলাদেশকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ওপেন গভর্নমেন্ট পার্টনারশিপে যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব দিয়ে বলা হয়েছে, এতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যাবে।
জাতীয় সনদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে কমিশন বলেছে, দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে জনগণের আস্থাহানি ঘটতে পারে।


