বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে এক বিশ্লেষণধর্মী পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন বিশিষ্ট লেখক, রাজনীতিবিদ এবং ইউটিউব ব্যক্তিত্ব ফাহাম আব্দুস সালাম (Fahim Abdus Salam)। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রকাশিত এক পোস্টে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে “প্রাসঙ্গিকতা” ধরে রাখতে হলে যেসব মৌলিক শর্ত মেনে চলতে হয়, তা এক ব্যতিক্রমী কল্পচিত্রে উপস্থাপন করেন।
তার মতে, দেশের রাজনীতিতে প্রভাবশালী হয়ে উঠতে হলে রাজনীতিকদের একটি “ত্রিভুজ” এর ভেতরে অবস্থান করতে হয়—একটি অদৃশ্য ত্রিভুজ, যার তিনটি প্রান্ত গঠিত হয়েছে তিনটি রেড লাইনের মাধ্যমে। এই সীমারেখাগুলোর বাইরে গেলে মূলধারার রাজনীতিতে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে।
ত্রিভুজের তিনটি রেড লাইন কী?
ফাহাম সালাম লেখেন, “বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনটা রেড লাইন আছে। এই তিনটা রেড লাইনের সমন্বয়ে আমি আপনাকে একটা ত্রিভুজ কল্পনা করতে অনুরোধ করছি। আপনি যদি বাংলাদেশে দলভিত্তিক রাজনীতি করতে চান ও ক্ষমতায় যেতে চান—আপনাকে এই ত্রিভুজের ভেতরে থাকতে হবে।”
এই তিনটি রেড লাইন তিনি নির্ধারণ করেছেন এভাবে:
- আপনি মুসলমানবিরোধী (Anti-Muslim) হতে পারবেন না।
- আপনি ভারতপন্থী (Pro-India) হতে পারবেন না।
- আপনি ১৯৭১-এর বিরোধী (Anti-1971) হতে পারবেন না।
তার বক্তব্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শ থাকলেও এই তিনটি মৌলিক রেড লাইন কারও পক্ষেই অতিক্রম করা সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী থেকে শুরু করে নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝেও এই সীমারেখাগুলোর উপস্থিতি বিভিন্ন রূপে বিরাজমান।
তিনি মন্তব্য করেন, “এই তিনটা রেড লাইন হোলো বাংলাদেশের এভরেজ একটা মানুষের চিন্তার চৌহদ্দি। রাজনীতির চৌহদ্দি না।” অর্থাৎ, এগুলো রাজনীতির দলীয় অবস্থানের নয়, বরং সাধারণ জনগণের মানসিক কাঠামোর প্রতিফলন। রাজনৈতিক দলগুলো তাই এই চৌহদ্দির বাইরে গিয়ে চলার চেষ্টা করলে জনসংযোগ হারিয়ে ফেলে।
আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও রাজনীতিতে রেড লাইন ভঙ্গের ঝুঁকি
ফাহাম সালামের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ দুটি এবং জামায়াত একটি রেড লাইন অতিক্রম করেছে, যার ফলে তারা জনমনে বিভ্রান্তি ও দ্বিধার মুখে পড়েছে। আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে ‘প্রো-ইন্ডিয়ান’ ভাবমূর্তি ও ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে এসেছে। অন্যদিকে জামায়াত তাদের অতীত ‘এন্টি-১৯৭১’ অবস্থানের কারণে মূলধারার বাইরে চলে গেছে।
এছাড়াও, ফাহাম সালাম সতর্ক করে দেন আরেকটি সম্ভাব্য রেড লাইনের বিষয়ে—“আপনি এন্টি-২০২৪ হতে পারবেন না।” যদিও তিনি জোর দিয়ে বলেন, “টু আর্লি টু সে যে এটা আসলেই একটা রেড লাইন হবে কি না।” অর্থাৎ, ২০২৪ সালের নির্বাচন ও তৎপরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে জাতির সংবেদনশীলতা এতটাই তীব্র যে ভবিষ্যতে এটি নতুন রেড লাইন হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
ত্রিভুজ থেকে চতুর্ভুজের পথে?
ফাহাম সালাম তাঁর বিশ্লেষণে উল্লেখ করেন, জামায়াত চায় তাদের অতীত ‘এন্টি-১৯৭১’ অবস্থানকে ‘এন্টি-২০২৪’ দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে। অন্যদিকে, সদ্য আত্মপ্রকাশকারী এনসিপি (NCP) দলটি চায় এই ত্রিভুজকে ‘চতুর্ভুজে’ রূপ দিতে—অর্থাৎ নতুন একটি রেড লাইন যুক্ত করে রাজনীতির কাঠামো পুনর্গঠন করতে। বিএনপি এই চেষ্টায় সরাসরি যুক্ত নয়, তবে তারা এখনো ‘১৯৭১’ প্রসঙ্গে তাদের অবস্থান পরিবর্তনের কোনো স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়নি।
ফাহাম আব্দুস সালামের পরামর্শ, “আপনি যদি লং-টার্মে বাংলাদেশের রাজনীতিতে, বিশেষ করে ভোটের রাজনীতিতে রেলেভেন্ট থাকতে চান—এই ত্রিভুজের ভেতরে থাকবেন – ভাঙবেন না। সমস্যা হতে পারে।” অর্থাৎ, রেড লাইনের বাইরে গেলে জনগণের সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার শঙ্কা থাকে, যার রাজনৈতিক মূল্য অনেক বেশি।
এই পর্যবেক্ষণমূলক বিশ্লেষণ শুধু রাজনৈতিক দল নয়, সাধারণ পাঠকের জন্যও একটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ উন্মোচন করে—যেখানে বোঝা যায়, রাজনীতি শুধু মতাদর্শের নয়, মানুষের বোধ ও অনুভূতির হিসাবও।