গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকারের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার একটি কঠোর আইন প্রণয়নের পথে এগোচ্ছে। আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রস্তুত করেছে ‘গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকার অধ্যাদেশ’-এর খসড়া, যেখানে গুমের অপরাধকে জামিন-অযোগ্য, আপস-অযোগ্য এবং আমলযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—গুমের শিকার ব্যক্তি মারা গেলে দোষী ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড এবং এক কোটি টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
খসড়া অনুযায়ী, গুমের মামলার বিচার হবে ‘গুম প্রতিরোধ ট্রাইব্যুনাল’-এ, যা হবে একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। অপরাধী দণ্ডিত হলে তাকে ঘোষিত অর্থদণ্ড ১৪ দিনের মধ্যে আদালতে জমা দিতে হবে। অর্থদণ্ড পরিশোধ না করলে তিনি উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারবেন না। এমনকি, আদালতের নির্দেশেই দোষীর সম্পত্তি ক্রোক ও নিলামে বিক্রি করে সেই অর্থ আদালতে জমা দেওয়ারও বিধান রাখা হয়েছে।
খসড়ায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র বা কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষের নির্দেশ, অনুমোদন বা মৌন সম্মতিতে কেউ যদি কাউকে অপহরণ, আটক বা স্বাধীনতা হরণ করেন এবং তার অবস্থান অস্বীকার বা গোপন করেন—তবে সেটি গুম হিসেবে গণ্য হবে। শুধু মূল অপরাধী নয়, যারা গুমের পরিকল্পনা, সহায়তা বা প্ররোচনা দেবে, তারাও সমান দণ্ডভোগ করবে। এমনকি কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যদি জানেন তার অধস্তন কেউ গুমের অপরাধে যুক্ত কিন্তু তবু কোনো ব্যবস্থা না নেন—তাহলেও তিনিও দণ্ডিত হবেন।
গঠিত হবে জাতীয় গুম প্রতিরোধ কমিশন
এই অধ্যাদেশ কার্যকর হলে সরকার ‘জাতীয় গুম প্রতিরোধ কমিশন’ গঠন করবে, যার কাজ হবে গুম সংক্রান্ত অভিযোগ গ্রহণ, তদন্ত ও তদারকি। এই কমিশন দেশের কারাগার, হাজতখানা ও আটককেন্দ্র পরিদর্শন করতে পারবে এবং আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ও বিচার বিভাগের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেবে। গুমের শিকার পরিবার থেকে তথ্য গ্রহণ, দপ্তরগুলোর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ এবং গাফিলতির অভিযোগ সুপ্রিম কোর্টের নজরে আনা কমিশনের অন্যতম দায়িত্ব হবে।
কমিশন গঠনের আগ পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন (National Human Rights Commission)।
অভিযোগ গ্রহণ এবং তদন্তের নতুন কাঠামো
গুমের শিকার ব্যক্তি বা তাদের স্বজনরা অভিযোগ করলে তা গ্রহণ করতে পারবেন প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট। এমনকি কমিশনের প্রতিবেদন ও পুলিশের প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনও আমলে নেওয়া যাবে। কমিশন চাইলে গুমের মামলার তদন্ত নিজে করতে পারবে বা সরকার চাইলে একটি বিশেষায়িত তদন্ত সংস্থা গঠন করতে পারবে। তবে কোনো সরকারি কর্মচারী গুমে জড়িত থাকলে, তার প্রতিষ্ঠানের কেউ সেই তদন্তে অংশ নিতে পারবে না।
গুমের দীর্ঘ ইতিহাস ও তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন
গত দেড় দশকে বাংলাদেশে বহু মানুষ গুমের শিকার হয়েছেন, যার অধিকাংশ অভিযোগ ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে। ২০২৫ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র ও সাধারণ মানুষের এক গণ-অভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস (Muhammad Yunus)। তার নেতৃত্বাধীন সরকারই গঠন করে ‘গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন’। হাজারো পরিবার অভিযোগ দাখিল করে, যেগুলোর তদন্তে উঠে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন পূর্বতন আওয়ামী লীগ সরকারের সরাসরি নির্দেশে বহু গুম সংঘটিত হয়েছে। কেউ কেউ ফিরে এলেও এখনও বহু ব্যক্তির খোঁজ মেলেনি। এমনকি কথিত ‘আয়নাঘর’-এর অস্তিত্বও মিলেছে, যা গুমের ভয়াবহতা ও গোপনীয়তার প্রতীক হয়ে উঠেছে।