অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে সরকার বা গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে সরাসরি হস্তক্ষেপ কমলেও, এখন নতুন করে গণমাধ্যমকে জর্জরিত করছে ‘মব হুমকি’র এক অদৃশ্য কিন্তু ভয়ঙ্কর ছায়া—এমন মন্তব্য করেছেন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ (Kamal Ahmed)।
সম্প্রতি এক আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি বলেন, “এখন আর গোয়েন্দা সংস্থা বা মন্ত্রণালয় থেকে ফোন আসছে না—কী ছাপতে হবে, কী বাদ দিতে হবে—সেই হস্তক্ষেপ বন্ধ হয়েছে। কিন্তু গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো আবারও এক ধরনের আত্মসংশয়ে, কারণ ‘মবের’ চাপ ও হুমকি এখন বাস্তব হয়ে উঠছে।”
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা কামাল আহমেদ রাষ্ট্র সংস্কারের প্রক্রিয়ায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্যতম সংস্কার উদ্যোগের নেতৃত্বে ছিলেন। প্রায় চার দশকের সাংবাদিকতা জীবনে তিনি বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস (BBC World Service) ও জাতিসংঘ রেডিও (UN Radio)-তে কাজ করেছেন।
‘ইনসাইড আউট’ নামের এক আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, নিয়ন্ত্রণ, চাপ এবং সাংবাদিকদের কর্মজীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। তিনি বলেন, সম্প্রতি গণমাধ্যম সম্পাদকরা জানিয়েছেন, ‘৫ আগস্ট’-এর পরে দৃশ্যত এক ধরনের পরিবর্তন এসেছে। আগে সরকারি মন্ত্রণালয়, সংস্থা, বিশেষ করে নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বিভাগ থেকে নিয়মিত ফোন আসত—“এই খবরটা ছাপবেন না”, “এই শিরোনাম বদলান” ইত্যাদি নির্দেশনা থাকত।
কামাল আহমেদের ভাষ্য, “এখন সেই ধরনের হস্তক্ষেপ আর নেই। সম্পাদকীয় স্বাধীনতা ফিরে এসেছে একদম শীর্ষপর্যায় থেকে। এটি নিঃসন্দেহে একটি বড় পরিবর্তন।” তবে এর মানে এই নয় যে গণমাধ্যম এখন পুরোপুরি স্বাধীনভাবে কাজ করছে। বরং তিনি বলেন, “মব হুমকি” এখন এক নতুন বাস্তবতা, যা গণমাধ্যমকে অদৃশ্য চাপে রেখেছে।
এই আত্মসেন্সরের বাস্তবতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কামাল বলেন, অনেক সম্পাদক এখনো সাহস করে সব খবর প্রকাশ করতে পারছেন না, কারণ সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে রাজনৈতিক বা ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর হুমকি বা আগ্রাসন বেড়েছে। “এক ধরনের ভয় কাজ করে—যদি কোনো নির্দিষ্ট মহল ক্ষিপ্ত হয়, যদি কোন গোষ্ঠী রাস্তায় নামে, অথবা সাংবাদিকদের টার্গেট করা হয়—এই ভয় থেকেই অনেক সম্পাদক সংবেদনশীল সংবাদ বাদ দিচ্ছেন।”
বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (Reporters Without Borders)-এর প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে বাংলাদেশের কিছু ইতিবাচক দিক। চলতি বছরে দেশে কোনো সাংবাদিক হত্যার ঘটনা না ঘটাকে তিনি ‘প্রশংসনীয় অগ্রগতি’ বলে মন্তব্য করেন।
তবে তাঁর মতে, প্রকৃত স্বাধীনতা তখনই অর্জিত হবে যখন সম্পাদকীয় সিদ্ধান্ত শুধু সরকারের নয়, ‘মবের’ হস্তক্ষেপ থেকেও মুক্ত থাকবে। কারণ, গোপন ফোন যেমন হুমকি, তেমনি উন্মত্ত জনতা বা সংগঠিত গোষ্ঠীর হুমকিও ভয়াবহ চাপ সৃষ্টি করে—যা সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ করে দেয়।
যেটাকে মব হুমকীর ভয় মনে করছে, সেটা আসলে বিবেকের দংশনের আতংক।
ভয় থাকা ভাল, নির্ভয় লোকেরাই বড় বড় দুর্ণিতির সুতিকাগার এদেশে