আলোচনায় ড.ইউনূসের ১০ মাসের আমলনামা

আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে কোণঠাসা ছিলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস (Muhammad Yunus)। কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর দৃশ্যপট বদলাতে শুরু করে। তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই, তাঁর সংশ্লিষ্ট গ্রামীণ (Grameen) গ্রুপভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো একে একে পাচ্ছে অনুমোদন, কর ছাড়, ও বাণিজ্যিক সুবিধা—যা ঘিরে শুরু হয়েছে ব্যাপক বিতর্ক ও স্বার্থসংঘাতের প্রশ্ন।

২০২৪ সালের ৮ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন ইউনূস। তারপর থেকেই গ্রামীণ সংশ্লিষ্ট একাধিক প্রতিষ্ঠান পায় সরকারের তরফ থেকে দীর্ঘদিন আটকে থাকা সুবিধা ও অনুমোদন। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকা শহরে নতুন অনুমোদিত ‘গ্রামীণ ইউনিভার্সিটি’, গ্রামীণ এমপ্লয়মেন্ট সার্ভিসেস লিমিটেড (জিইএসএল)-এর জনশক্তি রপ্তানির লাইসেন্স, এবং গ্রামীণ টেলিকমের ডিজিটাল ওয়ালেট চালুর অনুমতি। এমনকি আদালতেও ড. ইউনূস ও তাঁর সহকর্মীদের বিরুদ্ধে চলমান অর্থপাচার ও শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলা দ্রুত খারিজ হয়ে যায়।

২০২৪ সালের ১৭ ডিসেম্বরের মধ্যে মাত্র তিন মাসে অনুমোদন পায় ‘গ্রামীণ ইউনিভার্সিটি’—এটি ইউনূসের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর অনুমোদিত প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। একইভাবে, ২০০৯ সাল থেকে ঝুলে থাকা জিইএসএলের জনশক্তি রপ্তানির লাইসেন্স অনুমোদন পায় ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে (RL No. 2806)। প্রতিষ্ঠানটি এরপর বায়রা (BAIRA)-র সদস্যপদও লাভ করে।

গ্রামীণ টেলিকমের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ‘সমাধান সার্ভিসেস লিমিটেড’ ২০২৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর পায় পেমেন্ট সার্ভিস প্রভাইডার (পিএসপি) লাইসেন্স। উল্লেখ্য, ২০২১ সালের নভেম্বরে এই আবেদন করা হলেও আগের সরকার তা অনুমোদন দেয়নি।

সরকারি নীতি পর্যায়ে পরিবর্তন আসে গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষেত্রেও। ২০২৫ সালের ১৭ এপ্রিল একটি বৈঠকে, যার সভাপতিত্ব করেন ড. ইউনূস নিজেই, সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়—গ্রামীণ ব্যাংকে সরকারের শেয়ার কমিয়ে ২৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ করা হবে এবং নির্বাচিত সদস্যদের মধ্য থেকেই বোর্ড চেয়ার নির্ধারণ করা হবে। এতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ কার্যত বিলুপ্ত হয়।

এদিকে, ২০২৪ সালের ১০ অক্টোবর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) গ্রামীণ ব্যাংককে ২০২৯ সাল পর্যন্ত কর অব্যাহতির ঘোষণা দেয়, যা ২০২০ সালে বাতিল করা হয়েছিল আগের সরকারের আমলে। এনবিআর বলেছে, এটি তাদের নিয়মিত কর অব্যাহতির ধারাবাহিকতা হলেও, সময়কাল এবং প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে ইউনূসের বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি। ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেওয়ার তিন দিনের মাথায় ঢাকার একটি আদালত তাঁকে অর্থপাচার মামলায় খালাস দেয়। এমনকি তাঁর শপথ নেওয়ার আগের দিনই শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলাতেও তিনি এবং গ্রামীণ টেলিকমের পরিচালকেরা খালাস পান।

এসব ঘটনার প্রেক্ষাপটে স্বচ্ছতা ও স্বার্থসংঘাত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (TIB)। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “প্রধান উপদেষ্টার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে যেহেতু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তাই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।” তিনি পরামর্শ দেন, এসব সিদ্ধান্তের যৌক্তিক ভিত্তি জনসম্মুখে প্রকাশ করা হোক।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম অবশ্য দাবি করেন, এসব সুবিধা বা অনুমোদনের পেছনে কোনো সরকারি প্রভাব নেই। তিনি বলেন, “আপনারা বের করে দেখান যে এসব প্রতিষ্ঠানের অনুমোদনে সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ আছে কিনা। আমি নিজে তদন্তের আহ্বান জানাই।”

তিনি আরও জানান, গ্রামীণ এমপ্লয়মেন্ট সার্ভিসেস ২০০৯ সালেই লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছিল, কিন্তু আগের সরকার তা অনুমোদন দেয়নি। সৌদি আরব ও জার্মান হাসপাতাল চেইনের মাধ্যমে কম খরচে জনবল পাঠাতে চেয়েছিল তারা, কিন্তু তৎকালীন সরকার এ সুযোগ দেয়নি। একইভাবে, গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদনের জন্য ২০১২ সাল থেকে বহুবার আবেদন করেও সাড়া পায়নি। অথচ এখন, অডিট শেষ হতেই দ্রুত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

এই প্রসঙ্গে উঠছে আরেকটি মৌলিক প্রশ্ন—গ্রামীণ প্রতিষ্ঠানে ড. ইউনূসের ব্যক্তিগত মালিকানা কতটুকু? শফিকুল আলম বলেন, “এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে উনার ব্যক্তিগত শেয়ার বা সম্পদ আছে কিনা, কেউ দেখাতে পারবে?” গ্রামীণ সেন্টার ও গ্রামীণ শিক্ষা নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শেয়ার বণ্টন রয়েছে, তবে ইউনূস নিজে সরাসরি কোনো শেয়ারের মালিক কি না, সে বিষয়টি পরিষ্কার নয়।

সর্বশেষ এই বিতর্কে প্রশ্ন জেগেছে—একজন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে, যিনি দেশে সুশাসন ও স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনার অঙ্গীকারে এসেছেন, তাঁর নিজের সংশ্লিষ্টতা থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোই যদি একের পর এক সুবিধা পেতে থাকে, তবে তা কতটা নৈতিক এবং গ্রহণযোগ্য?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *