কেবলমাত্র বিচার, সংস্কার আর নির্বাচনই নিয়েই কি অন্তবর্তী সরকার সংকটে ?

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস (Muhammad Yunus) পদত্যাগ করতে যাচ্ছেন—এমন গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ার পর সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দিয়েছে, তিনি পদত্যাগ করছেন না এবং তার উপদেষ্টারাও দায়িত্বে বহাল থাকছেন। তবে এই ঘোষণার মধ্যেও রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে তীব্র টানাপোড়েন, অনাস্থা ও জটিল সমীকরণের পর্যালোচনা।

শনিবার একনেক বৈঠকের পর উপদেষ্টা পরিষদের এক অনির্ধারিত বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয় বলে জানান পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ (Wahiduddin Mahmud)। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা কখনোই সরাসরি সরে যাওয়ার কথা বলেননি বরং দায়িত্ব পালনে প্রতিবন্ধকতার কথা বলেছেন, কিন্তু দায়িত্ব ছেড়ে যাবেন না বলেই পরিষ্কার ইঙ্গিত দিয়েছেন।”

একই দিনে উপদেষ্টা পরিষদের পক্ষ থেকে সন্ধ্যায় একটি বিবৃতিও দেয়া হয়, যেখানে বলা হয়, “যদি পরাজিত শক্তির ইন্ধনে এবং বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সরকারের উপর আরোপিত দায়িত্ব পালন অসম্ভব হয়ে ওঠে, তবে তা জনসমক্ষে ব্যাখ্যা দিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।”

রাজনৈতিক বৈঠকের ঘনঘটা
শনিবার রাতে অধ্যাপক ইউনূস রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় বৈঠকে বসেন তিনটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে—বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। বৈঠকগুলোর কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল নির্বাচন ইস্যু ও তার সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ।

বিএনপি এক বিবৃতিতে জানায়, তারা প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ চায় না বরং “বিতর্কিত উপদেষ্টাদের বাদ দিয়ে পরিষদের পুনর্গঠন” দাবি করেছে। দলটি জানায়, “যেকোনো উছিলায় নির্বাচন বিলম্বিত হলে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের জন্য পথ তৈরি হবে।”

জামায়াতের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা ফেব্রুয়ারি কিংবা রমজানের পরেই নির্বাচন চায়, কিন্তু সেটি আর টানলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে না।

এদিকে এনসিপি বলেছে, নির্বাচন কমিশন সংস্কার করে “লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড” নিশ্চিত করতে হবে।

তবে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ জানানো হয়নি বলেই জানায় দলগুলো।

সংকটের শিকড় কোথায়
বিশ্লেষকরা বলছেন, সংকটের সূত্রপাত কোনো একটি ঘটনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান (Waqar-uz-Zaman)-এর বক্তব্য, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, এবং এনসিপির বাড়াবাড়ি আচরণ সরকারের প্রতি জনআস্থা কমিয়েছে।

বিশ্লেষক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বলেন, “নির্বাচন ইস্যু ছাড়াও ‘মব কালচার’, বিচারব্যবস্থার দুর্বলতা এবং উপদেষ্টা নির্বাচনে পক্ষপাতিত্ব সরকারকে নাজুক অবস্থানে এনেছে।”

তার মতে, সরকার সংস্কারে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার পরিবর্তে এককভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ায় এ অবস্থা হয়েছে।

বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরীনের মতামত, “সরকার একা চলার চেষ্টা করেছে, এনসিপিকে বাড়তি প্রাধান্য দিয়েছে এবং বিএনপি বনাম এনসিপি ছায়াযুদ্ধ তৈরি হয়েছে, যেখানে এনসিপি সরকারপুষ্ট হয়ে উঠেছে।”

এদিকে, সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার পদত্যাগ নিয়ে বিএনপির দাবি ঘিরেও তৈরি হয়েছে নতুন বিতর্ক। বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র হিসেবে শপথ চাইলে তার সমর্থকদের রাস্তায় অবস্থানের ঘটনাও সরকার-বিএনপি সম্পর্ক আরও খারাপ করে।

প্রেস সেক্রেটারির বক্তব্য এবং সেনাপ্রধানের অবস্থান
সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে, নির্বাচন কখন হবে তা এখনও নির্ধারিত হয়নি। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেন, “নির্বাচন এক বছর, দেড় বছর, কিংবা আট মাস পরে—এখনই বলা যাচ্ছে না।” অপরদিকে সেনাপ্রধান বলেছেন, “গণতান্ত্রিক উত্তরণ এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে হওয়া উচিত।”

এমন অবস্থানে দ্বিধা স্পষ্ট হয়েছে সরকার ও সেনাবাহিনীর মধ্যে।

এনসিপির অবস্থান ও বিএনপির অভিযোগ
বিএনপি বলছে, এনসিপির নেতা-উপদেষ্টারা একতরফাভাবে সরকারকে প্রভাবিত করছেন এবং এনসিপি বিএনপির বিরুদ্ধাচরণে সরকারের প্রশ্রয় পাচ্ছে। বিএনপি দাবি করেছে, বিতর্কিত উপদেষ্টাদের অব্যাহতি না দিলে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হবে না।

এনসিপি অবশ্য বলেছে, বিতর্কিত দুই উপদেষ্টা তাদের দলের কেউ নয়। তবে সরকারের প্রতি জনগণের আস্থার সংকট যে ক্রমশ বেড়েছে, তা সরকারি কর্মকর্তাদের সাম্প্রতিক বক্তব্যেও প্রতিফলিত হচ্ছে।

প্রধান উপদেষ্টার অবস্থান
পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, “আমাদের উপর যে দায়িত্ব এসেছে, সেটি ছেড়ে যাওয়া যায় না। ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই দায়িত্ব পালনের উপর।”

তিনি বলেন, “আমরা দেখছি, কোথা থেকে প্রতিবন্ধকতা আসছে। আমরা সেটি চিহ্নিত করে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করব।”

সংকট কতখানি গভীর
দশ মাস আগে অধ্যাপক ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের শপথের পর আশার আলো দেখা গেলেও সময়ের সাথে সেই আস্থা ভেঙে পড়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। অর্থনীতি, আইনশৃঙ্খলা, ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় কাঙ্ক্ষিত উন্নতি না হওয়ায় প্রধান উপদেষ্টা ও তার দল আজ প্রশ্নবিদ্ধ।

বিশ্লেষক সাইফুল হক বলেন, “সংকট সরকারই তৈরি করেছে। তারা রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থাভাজন হতে পারেনি বরং নিজেই প্রতিপক্ষ সৃষ্টি করেছে।”

বর্তমানে প্রধান উপদেষ্টা বহাল থাকলেও রাজনৈতিক বিরোধ, অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা এবং রোডম্যাপ ঘিরে অনিশ্চয়তা স্পষ্ট করছে যে, সামনে আরও উত্তেজনাপূর্ণ সময় অপেক্ষা করছে দেশের জন্য। তথ্যসূত্র : বিবিসি বাংলা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *