সালাহউদ্দিন আহমেদের ‘গুম’ নিয়ে তৈরি হওয়া প্রচারণা ও তার বাস্তবচিত্র

বিএনপির নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদকে নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ের অনলাইন প্রচারণা ও বিভ্রান্তিমূলক ন্যারেটিভ গড়ে তোলার চেষ্টা যেনো তার ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডিকে মুছে ফেলতে চায়। কিন্তু সেই প্রচেষ্টার আগে কিছু অপরিহার্য ঘটনা ও প্রমাণ জানা দরকার, যেগুলো তার গুম, বিদেশে অবস্থান এবং ফিরে আসার পুরো কাহিনি স্পষ্ট করে।

২০১৫ সালের মার্চ মাসে হঠাৎ নিখোঁজ হন সালাহউদ্দিন আহমেদ (Salahuddin Ahmed)। নিখোঁজ হওয়ার পরপরই তার স্ত্রী হাসিনা আহমেদ (Hasina Ahmed) উচ্চ আদালতে একটি রিট আবেদন করেন, যেখানে তিনি স্বামীর খোঁজ চেয়েছিলেন। ফলে এই ঘটনা আর দশটি গুমের মতো সহজে চাপা পড়ে যায়নি। আদালতের শুনানি তালিকাভুক্তও হয়েছিল, যদিও রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দাবি করে, পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেনি। (সূত্র)

এই গুম আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও আলোড়ন তোলে। Human Rights Watch একটি রিপোর্টে উল্লেখ করে, ২০১৫ সালের ১০ মার্চ সন্ধ্যায় সালাহউদ্দিনকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে কয়েকজন তুলে নেয়। (সূত্র)

৬১ দিন পর সালাহউদ্দিনকে খুঁজে পাওয়া যায় প্রতিবেশী দেশ ভারতের শিলং (Shillong) শহরে। তখন তাকে অনেকটা মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষের মতো দেখানো হয় এবং প্রথমেই একটি মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মেঘালয় পুলিশ পরে তার বিরুদ্ধে ফরেনার্স অ্যাক্টে মামলা করে, কারণ তিনি বৈধ কাগজপত্র ছাড়া ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছিলেন।

২০১৮ সালে নিম্ন আদালতে খালাস পেলেও ভারতের সরকার আপিল করে। তার ফলে সালাহউদ্দিন দেশে ফিরতে পারেননি; এমনকি অন্য শহরে চিকিৎসার জন্য যাওয়ার অনুমতিও মেলেনি। অবশেষে ২০২৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আপিলে পুনরায় খালাস পান এবং আদালত তাকে দেশে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দেন। এরপর সেই বছরের ৮ মে তিনি ভারতের আসাম সরকারের কাছে ভ্রমণ পাসের আবেদন করেন, যা দীর্ঘদিন ঝুলে ছিল। (সূত্র)

এই বাস্তবতা সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে এখন অপপ্রচার চালানো হচ্ছে যে, তিনি নাকি ‘র’ এর এজেন্ট ছিলেন এবং গুমের বিষয়ে কোনো অভিযোগ জানাননি। এটি সম্পূর্ণ মিথ্যাচার। তিনি জাতিসংঘের গুম সংক্রান্ত কমিশনেও অভিযোগ করেন। (সূত্র)

বিপরীতে, যারা এখন তার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ ছড়াচ্ছেন, তাদের মধ্যে একজন পিনাকি ভারত হয়ে নিরাপদে ফ্রান্স চলে যেতে পেরেছেন, যার বিরুদ্ধে কোনো অনুপ্রবেশ মামলা হয়নি, ট্রাভেল পাস আটকে রাখা হয়নি।

২০১৪-১৫ সালে আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বিএনপির আন্দোলনের সময় সালাহউদ্দিন ছিলেন আন্দোলনের অন্যতম বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। সে সময় অধিকাংশ বিএনপি নেতা গ্রেফতার ও দমন-পীড়নের শিকার হলেও তিনি ভিডিও বার্তার মাধ্যমে আন্দোলনকে উজ্জীবিত রাখেন। (সূত্র)

এই ভূমিকাই সম্ভবত তাকে আওয়ামী সরকারের অন্যতম প্রধান টার্গেটে পরিণত করে। গোটা রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে তাকে নিঃস্ব করার চেষ্টা হয়। ২০১৫ সালের ১০ মার্চ তাকে ডিবি ট্র্যাক করে তুলে নেয় এবং ৬১ দিন অদৃশ্য রেখে পরবর্তীতে মেঘালয়ে ফেলে রেখে আসে।

এই প্রতিবেদনকারীর সঙ্গে সালাহউদ্দিন আহমেদের ব্যক্তিগত যোগাযোগের প্রসঙ্গও এখানে প্রাসঙ্গিক। সাংবাদিক হিসেবে ‘সমকাল’ থেকে চাকরি হারানোর পর ‘মানবজমিন’-এ কর্মরত থাকাকালে ভারতের আদালতের রায় উপলক্ষে সালাহউদ্দিনের যোগাযোগসূত্রে মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করা হয় পেকুয়া উপজেলার এক বাসিন্দার কাছ থেকে। এরপর তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হয়। ৫ আগস্ট দেশে ফেরার পর ২৯ আগস্ট গুলশানের বাসায় গিয়ে তার একটি ছবিও তোলা হয়।

শুধু ভিন্নমত বা বিরোধী রাজনীতির কারণে যে ভাবে একটি গুমের শিকার মানুষকে নিয়ে অসত্য প্রচার ও চরিত্র হননের চেষ্টা চলছে, তা গভীরভাবে দুঃখজনক। একজন গুম হওয়া ব্যক্তির পরিবারের সদস্য হিসেবে এই অভিজ্ঞতা যে কতটা বেদনাদায়ক এবং দীর্ঘস্থায়ী ট্রমা তৈরি করে, তা সহজে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।

আজকের সামাজিক মাধ্যমে দু’ধরনের লোক দেখা যায়—এক দল তথাকথিত শিক্ষিত যারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মিথ্যা ছড়ায়, আরেক দল নির্বোধ যারা এসব বিশ্বাস করে। সালাহউদ্দিন আহমেদের গুমকে ‘সাজানো নাটক’ বলার প্রবণতা মূলত এই প্রথম শ্রেণিরই তৈরি। তবে আশা থাকে—সত্য সবসময়ই শক্তিশালী এবং দীর্ঘমেয়াদে তা প্রতিষ্ঠা পায়। প্রতিবেদনটি সাংবাদিক ইহসান মাহমুদের ফেসবুক পোষ্ট হতে সংগৃহীত

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *