বাংলাদেশে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার বানানো যদি একটা সংগঠন থেকে থাকলে সেটা হলো এবি পার্টি

আল জাজিরার অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের তাঁর ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে প্রকাশ করেছেন একটি গভীর পর্যবেক্ষণমূলক ও আলোচিত পোস্ট, যেখানে তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি বিশেষ বিদেশি চক্রের প্রভাব এবং জামায়াতে ইসলামীর অভ্যন্তরীণ ভাঙন প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন।

তিনি পোস্টটিতে দাবি করেছেন, কীভাবে ২০০১ সালের পর থেকে ভিন্ন কৌশলে জামায়াতকে দুর্বল করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয় এবং সেই পরিকল্পনায় জড়িত ছিলেন দেশি ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহল।

পোস্টটি নিচে হুবহু তুলে ধরা হলো, পাঠকের বিবেচনার জন্য:

বাহ্যিকভাবে আধিপত্যবাদবিরোধী বুদ্ধিজীবীতা বা অ্যাক্টিভিজমের আড়ালে বাংলাদেশে কেউ কেউ আছেন যারা প্রকৃত অর্থে একটি বিশেষ বিদেশি শক্তির হয়েই মাঠে আছেন।

২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির সাথে জোট করে পাওয়ারে আসার পর থেকেই বিদেশি শক্তি ও তাদের দেশী এজেন্টরা সক্রিয় হয়ে উঠে দুইটা পদ্ধতিতে জামায়াতের উত্থান ঠেকানোর জন্য। এক- যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধের নামে জামায়াতের শীর্ষনেতাদের বিতর্কিতভাবে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যার প্ল্যান যেটা পরবর্তীতে লীগের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করেছে; দুই- জামায়াতে ভাংগন ধরিয়ে জামায়াতের শক্তি দূর্বল করা।

আজকের পোস্টটি সেকেন্ড পয়েন্টে। জামায়াতকে দূর্বল করা ও ভাংগনের দায়িত্ব নেন বাম নেতা ফরহাদ মজহার ওরফে গফুর এবং নুরুল ইসলাম ভূঁইয়া ছোটন। রাতারাতি বাম নাস্তিক ফরহাদ মজহার বনে যান ধার্মিক চিন্তক। জামায়াত হেফাজত সহ সব ঘরানার ইসলামপন্থীদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ান।

নয়াদিগন্তে নিয়মিত লিখার মাধ্যমে জামায়াতের সুদৃষ্টি পান এবং জামায়াত শিবিরের কিছু টপ’নচ মানুষদের কাছে রিচ করতে পেরেছেন। অনেকেই তখন মনে করতো ফরহাদের লাইফে আল মাহমুদের মতো চেইঞ্জ আসছে- বামপন্থী থেকে ডানপন্থী/ইসলামপন্থী হয়েছে। শাহবাগের পতনের পর লন্ডনে গিয়ে জামায়াতপন্থীদের এক অনুষ্ঠানে বেশ জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়েছিলো এই গফুর। হেফাজতের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছে।

এভাবেই বকধার্মিক ফরহাদ মজহার, শিবিরের ছেলেদের তার চিন্তা পাঠচক্রে আমন্ত্রণ জানান। চলতে থাকে ব্রেনওয়াশ। শিবিরের সিলেবাস যেহেতু মোস্টলি ইসলাম ফোকাসড, বাম ন্যারেটিভের জায়গা থেকে সমাজকে চিনার বা অ্যানালাইসিস করার জ্ঞান তাদেরকে ইম্প্রেস করে এবং সে কারণে অনেক জ্ঞান শিখার জন্য দলে দলে চিন্তা পাঠচক্রে যেতে থাকে।

আগে জামায়াত বিরোধীরা জামায়াত শিবির উভয় গ্রুপকেই গালি দিতো সমানতালে- রাজাকার আলবদর এসব বলে। জামায়াতের যেমন আগের লিগ্যাসি আছে, শিবিরেরও ছাত্রসংঘের লিগ্যাসি আছে। এ প্রজন্মের জামায়াতকে যেমন রাজাকার বলতো, শিবিরকেও বলতো। ওদের হিসেবে শিবিরের প্রতিষ্ঠাতারাই রাজাকার আলবদর- মীর কাশেম,কামারুজ্জামান, তাহের।

কিন্তু ফরহাদ ছোটনরা নিয়েছেন ভিন্ন পথ। গালি দিয়ে কাজ হবে না। বরং এভাবে গালি দেয়ার চেয়ে দুই গ্রুপের মধ্যে ভাংগন ধরাতে পারলে বেটার। তারা শিবিরের ছেলেদের বললো- দেখো তোমরা ব্রিলিয়ান্ট, ডিসিপ্লিনড, স্মার্ট; এরকম বাংলাদেশে আর একটা ছাত্র সংগঠনও নাই। তোমাদের দ্বারাই সঠিক রাজনীতি করা সম্ভব। কিন্তু জামায়াত খারাপ, স্মার্ট না, এদের দ্বারা কিছু হবে না। জামায়াতের একাত্তরের কাঁদা আছে, তোমাদের তো সে সময় জন্মই হয় নি, তোমরা কেন একাত্তরের সে দায় নিবা। তোমাদের নতুন রাজনীতি করা দরকার ইত্যাদি ইত্যাদি। তার উপর বিদেশি শক্তির প্রভাব এবং গ্লোবাল ওয়ার অন টেররের কারনে যে বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতি কখনোই সাকসেস হবে না, অযথা সময় নষ্ট না করে সেক্যুলার রাজনীতি দাঁড় করানো উচিত এধরণের তালিম আসতে থাকে। যেগুলো তরুনদের আকৃষ্ট করে। এসব পাঠচক্রান্ত্রে ফরহাদ, গৌতম, পিনাকি, মুসতাইন জহির সহ একটা বড় গ্রুপ কাজ করে।

কিন্তু দল দাঁড় করাতে হলে তো একটা বিগফিশ দরকার। চুনোপুঁটি নিজে বিভ্রান্ত হবে বা হতাশ হবে কিন্তু দল ভেংগে আরেকটা দলতো দাঁড় করাতে পারবে না। সে দায়িত্ব পড়ে ছোটন গং এর হাতে।

সে সময় দিগন্ত টিভির দায়িত্ব পান মুজিবুর রহমান মঞ্জু। টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে মঞ্জু ডিপস্টেটের নানান লোকজনের সাথে উঠাবসা করতে করতে পড়ে যান ছোটন, ফরহাদদের খপ্পরে। এরকম একজন লোক যার সাংবাদিকতা করার অভিজ্ঞতা নাই, ডিপস্টেট চিনার বুঝার মত জ্ঞান নাই, তারে টিভি প্রধান দায়িত্ব দেয়ায় সে দায়িত্বের কারণে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়েছে। সেখান থেকে সহজ শিকারে পরিণত হয়েছে। নতুন নতুন চিন্তা তাকে মোহিত করে। নিজের অজ্ঞাতসারেই এ চক্রের হাতে পড়ে জামায়াত ভাংগার উদ্যোগের প্রধান চরিত্র হয়ে যায়। তাকে ট্রেইন্ড আপ করেছে ফরহাদ মজহার। সেখান থেকেই এবি পার্টি।

জামায়াতের ভিতরে নানান সংস্কার ইস্যুতে রিজিডিটি, একাত্তরে স্বাধীনতার বিরোধিতা করা, এবং ২০১০ এ শিবিরের ভাংগনের কারণে অনেক নেতার দল ছেড়ে যাওয়া ইত্যাদি কারণে একটা গ্রুপকে মোবিলাইজ করা মুজিবুর রহমান মঞ্জুর জন্য সহজ হয়ে যায়।

এবি পার্টির প্রধান রাজনৈতিক গুরু হয়ে উঠে ফরহাদ মজহার। এবি পার্টির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ফরহাদ মজহারকে প্রধান রাজনৈতিক গুরু হিসেবে পরিচয়ও করিয়ে দেন মনুজ। এবি পার্টির গঠনতন্ত্র লিখে দেয় ছোটন গ্যাং এর আরেক সদস্য মুসতাইন জহির যেটা সে সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক আলোচিত ব্যাপার ছিলো। আর ফান্ডের একটা বড় অংশের যোগান আসে ছোটনের হাত ধরে।

আর সর্বশেষ সংযোজন হলো পিনাকীর তিনজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু হচ্ছে ছোটন, মুসতাইন জহির, ও মঞ্জু। পিনাকিকে বাংলাদেশ থেকে পালানোর সময়ও হেল্প করেছে মুজিবুর রহমান মঞ্জু।

বাংলাদেশে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার বানানো যদি একটা সংগঠন থেকে থাকলে সেটা হলো এবি পার্টি। সব মানুষ বুঝে শুনে এজেন্সির এজেন্ট হয় না, একটা নয়েজের মধ্যে আটকা পড়েও হয়। মঞ্জু হয়তো সেরকম একজন।

বিদেশি চক্র তার চিরশত্রু জামাতকে দুই ফ্রন্টেই খেলে দিলো- লীগকে দিয়ে ‘বিএনপি-জামাতের’ মেইন ফিগারগুলোকে খুন করালো, আর মঞ্জুকে দিয়ে জামায়াতকে দুই ভাগ করালো।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *