ড.ইউনূসকেই তার লিমিট এবং রাজনৈতিক বাস্তবতা বুঝতে হবে

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় ড. ইউনূস যেসব বক্তব্য বা অভিপ্রায় প্রকাশ করেছেন, তার পুরোটা বিএনপি কিংবা ইসলামী দলগুলোর পক্ষ থেকে প্রকাশ না পেলেও, এবি পার্টি বা আমার বাংলাদেশ পার্টির মুজিবুর রহমান মঞ্জু কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেছেন।

মঞ্জু বলেন, “ড. ইউনূসের মূল লক্ষ্য একটি সুষ্ঠু এবং ঐতিহাসিক নির্বাচন সম্পন্ন করা। কিন্তু সেটি নিশ্চিত করতে হলে প্রশাসনসহ সব ক্ষেত্রে তাঁর নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তিনি যখন বুঝবেন যে তিনি স্বচ্ছন্দভাবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন, তখন তিনি একটি নির্দিষ্ট তারিখ বা রোডম্যাপ ঘোষণা করবেন।”

মঞ্জুর এই বক্তব্য থেকে ধারণা করা যায়, ড. ইউনূস এখনো নিজের অবস্থান ও ম্যান্ডেট নিয়ে দ্বিধায় আছেন। একদিকে, তিনি একটি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন, কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার পূর্ণ সুযোগ বা সহায়তা তিনি পাননি। এতে তার কর্তৃত্ব কার্যকর হয়নি, এবং অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে তাঁর অবস্থান অনেকটা প্রতীকী বা ‘নখ-দাঁতহীন’ হয়ে পড়েছে।

উপদেষ্টা পরিষদের বিবৃতিতে ড. ইউনূস জানিয়েছেন, যদি তিনি কাজে বাধাগ্রস্ত হন বা নিজেকে অসক্ষম মনে করেন, তবে তিনি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি নিজেও কি নিজের অবস্থান পরিষ্কার করতে পেরেছেন? মনে হচ্ছে, তিনি নিজের সিদ্ধান্তে এবং নিজস্ব ভাবনার গহ্বরে বন্দী হয়ে পড়েছেন।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই পরিস্থিতিতে ‘মিরাকল’ ছাড়া সমাধান দেখা কঠিন। দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ ছাড়া এবং সমালোচিত বিষয়গুলো মোকাবিলা না করলে, এই সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়।

বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে কেউ কেউ তুলনা করছেন ২০২০ সালের যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের প্রাক্কালীন সময়ের সঙ্গে—যেখানে এক অনিশ্চয়তা ও সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। বাংলাদেশেও এখন অনেকটা একই অবস্থা: কে নেতৃত্ব দেবে, সেটি স্পষ্ট নয়, আর পুরো রাষ্ট্র একটি অনিশ্চিত ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।

ড. ইউনূসের মূল সমস্যা, অনেকে মনে করছেন, তার ‘ম্যান্ডেট’ বা ক্ষমতা নিয়ে দ্বিধা এবং তা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে না পারা। মুজিবুর রহমান মঞ্জুর মতে, জনগণ ড. ইউনূসকে পরিবর্তনের জন্য একটি ম্যান্ডেট দিয়েছে—কিন্তু তা কার্যকর করতে গেলে দায়িত্ব পালনের সুযোগও থাকতে হয়। যখন মানুষ এই ম্যান্ডেটের দৃশ্যমান অগ্রগতি খুঁজে পায় না, তখনই প্রশ্ন উঠে: এই ম্যান্ডেটের বাস্তবায়ন কোথায়?

তিনি আরও বলেন, “যদি আর্মি, বিএনপি বা অন্য কেউ এই ম্যান্ডেটকে আন্ডারমাইন করে, তাহলে ইউনূস আর তাঁদের শর্তে থাকবেন না।”

ড. ইউনূসের আচরণ এখন অনেকটা শিশুসুলভ—‘আমার এইটা চাই, না পেলে আমি কাজ করব না’। কিন্তু এই দাবিদাওয়ার পেছনে রাজনৈতিক দলের বা সেনাবাহিনীর সহযোগিতা ছাড়া কাজ করা সম্ভব নয়। এতদিন সবাই তাকে সহযোগিতা করেছে, কিন্তু ড. ইউনূস মনে করেছেন, কেবল ছাত্রসমাজই তার আসল ভিত্তি—যা রাজনৈতিক বাস্তবতায় যথেষ্ট নয়।

একজন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে তার দায়িত্ব হচ্ছে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করা। কিন্তু এখন এমন একটি ধারণা জন্ম নিচ্ছে যে, তিনি হয়তো এই দায়িত্ব থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে চাইছেন না—যার ফলে রাজনৈতিক দলগুলো তার পদক্ষেপে সন্দিহান হয়ে পড়ছে।

বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা হলো, প্রায় চার কোটি মানুষ আজ কর্মহীন অথবা খুবই অল্প আয়ে জীবিকা চালাচ্ছেন। তারা বিদেশ যেতে পারছেন না, দেশেও কাজ পাচ্ছেন না, অথচ ডিজিটাল মিডিয়া ব্যবহার করছেন—এই অসাম্য সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করছে।

এই বাস্তবতায় যদি কোনো সরকার বা নেতৃত্ব বিদেশি শক্তিকে দেশের নিরাপত্তা বা অপারেশনাল দায়িত্ব দেয়, তাহলে তা দেশের সার্বভৌমত্বের সঙ্গে আপোষ করার সামিল হবে। অতীতে আমরা দেখেছি, নির্বাচিত সরকার যেমন শেখ হাসিনার নেতৃত্বেও সব সিদ্ধান্ত নিঃশর্তভাবে গৃহীত হয়নি; রাজনৈতিক দল ও জনগণ বারবার প্রশ্ন তুলেছে। এর পরেও শেখ হাসিনা তার রাজনৈতিক দলের শক্তিতে সেই বাধাগুলো পার করেছেন।

কিন্তু ড. ইউনূসের পাশে সে ধরনের রাজনৈতিক কাঠামো নেই। তাঁর পেছনে কোনো দলীয় মেশিনারি বা জনপ্রতিনিধির ভিত্তি নেই। তাই তিনি যদি নির্বাচনের তারিখ না জানান, কিংবা বোঝাতে ব্যর্থ হন যে তিনি কীভাবে নেতৃত্ব দেবেন, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলো ধরে নেবে যে তিনি ক্ষমতা ছাড়তে চান না। এতে সংকট আরও গভীর হবে।

এই মুহূর্তে বাংলাদেশ এমন এক পরিস্থিতিতে আছে, যেখানে সেনাবাহিনী, রাজনৈতিক দল ও জনগণ—সব পক্ষকে সমন্বয় করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ড. ইউনূস যদি এই ‘ন্যাচারাল লিমিট’ এবং রাজনৈতিক বাস্তবতা বুঝে পদক্ষেপ না নেন, তাহলে অবস্থা আরও জটিল হতে পারে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *