আওয়ামী লীগের শাসনামলে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১৮ থেকে ২০ বিলিয়ন ডলার অর্থপাচার হয়েছে বলে এক চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছেন আহসান এইচ মনসুর (Ahsan H. Mansur)। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মঙ্গলবার (২৭ মে) অর্থ পাচার প্রতিরোধে কাজ করা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (Bangladesh Financial Intelligence Unit – BFIU) এর ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এই মন্তব্য করেন।
গভর্নর জানান, পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা থেকে ২ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যেই একজন ব্যক্তি বিদেশে ৩৫০টি বাড়ি কিনেছেন বলেও তথ্য দিয়েছেন তিনি। এসব বাড়ির জন্য অর্থ নেওয়া হয়েছে দেশের ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিয়ে। গভর্নরের ভাষ্য, “এই অর্থ পাচারের ঘটনা আমরা উদঘাটন করতে পেরেছি এবং দিন দিন এ ধরনের লেনদেন বেড়েই চলেছে।”
অর্থ পাচার রোধ ও অর্থ ফেরতের পথ
গভর্নর মনসুর আরও বলেন, “পাচার করা অর্থ ফেরত আনা আমাদের জন্য একেবারেই নতুন একটি চ্যালেঞ্জ। এ জন্য আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমিয়ে এই প্রক্রিয়া সহজ করতে আইন সংশোধনের কাজ চলছে। ইতোমধ্যে ১১টি গ্রুপের সমন্বয়ে যৌথ তদন্ত শুরু হয়েছে।”
তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনতে ৩ থেকে ৫ বছর সময় লাগতে পারে। ইতোমধ্যে বিদেশে এক ব্যক্তির সম্পদ জব্দ হয়েছে। সামনে আরও সম্পদ জব্দের সম্ভাবনার কথাও জানান গভর্নর। তবে তিনি স্পষ্ট করেন যে, “আমাদের উদ্দেশ্য কাউকে হয়রানি করা নয়, বরং আদালতের বাইরেই সমাধান টেনে এনে অর্থ উদ্ধারে চাপ তৈরি করা।”
আলোচিত প্রতিবেদন ও পরিসংখ্যান
সভায় আরও জানানো হয়, চলতি অর্থবছরে বিএফআইইউতে সন্দেহজনক লেনদেন ও কার্যক্রম সংক্রান্ত ১৭ হাজার ৩৪৫টি রিপোর্ট (STR/SAR) জমা পড়েছে, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ২৩% বেশি। এ ছাড়া ১১৪টি আর্থিক গোয়েন্দা প্রতিবেদন বিভিন্ন তদন্ত সংস্থায় পাঠানো হয়েছে এবং ১,২২০টি তথ্য বিনিময় হয়েছে—যা আগের বছরের তুলনায় ১৩.৯১% বেশি।
BFIU প্রধান এ এফ এম শাহীনুল ইসলাম বলেন, “অর্থ পাচার ও হুন্ডি এখন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতা ও বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।” তিনি জানান, অন্তর্বর্তী সরকারের নির্দেশনায় এ প্রক্রিয়ায় গতি আনার চেষ্টা চলছে এবং পাচার করা অর্থ ফেরাতে ১১টি গ্রুপের মাধ্যমে যৌথ তদন্ত হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতা
বিএফআইইউর প্রধান জানান, এ কাজে বিশ্বব্যাংক (World Bank), ইউএসডোজ, আইসিসিসি ও আইসিএআর-এর সহযোগিতা নেওয়া হচ্ছে। এমনকি বিদেশি আইনি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করে অর্থ উদ্ধারের চেষ্টাও শুরু হয়েছে। তবে এটি দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল প্রক্রিয়া হওয়ায় ধৈর্য নিয়ে কাজ চালিয়ে যেতে হবে বলে জানান তিনি।
বিএফআইইউর পরিচালক মুহাম্মদ আনিছুর রহমান বলেন, “অর্থ পাচার চিহ্নিত ও উদ্ধার একটি ধারাবাহিক ও চলমান প্রক্রিয়া। গত জুলাইয়ের পর থেকে বিএফআইইউর কার্যক্রম অনেক বেড়েছে—সন্দেহজনক লেনদেনের রিপোর্টও বেড়েছে, এবং বিভিন্ন সংস্থায় পাঠানো রিপোর্ট চার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।”
বাংলাদেশে অর্থ পাচার কেবল অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণ নয়, এর মাধ্যমে দেশ থেকে বৈধ পুঁজি বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনাও উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। এ অবস্থায় আইন সংস্কার, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং অভ্যন্তরীণ সুশাসনের সমন্বিত প্রয়াস ছাড়া এ সংকট থেকে উত্তরণ কঠিন হয়ে পড়বে।