২৭ লাখ মানুষ আরও দরিদ্র হয়েছে, কী বৈষম্যবিরোধী শেখাচ্ছেন আমাকে অন্তর্বর্তী সরকার! দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের ক্ষোভ

স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য (Debapriya Bhattacharya) বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের বাজেট প্রক্রিয়া ও আর্থিক নীতির স্বচ্ছতা নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি বলেন, “সরকার বদল হলেও প্রক্রিয়ার বদল হলো না, আর্থিক পরিকল্পনার কোনো দিকনির্দেশনা নেই।”

সংস্কারের এত আয়োজন, অথচ জনজীবনে এর প্রভাব অনুল্লেখযোগ্য—এই মর্মবেদনার কথাই তুলে ধরেন তিনি। “এতগুলো সংস্কারের কর্মসূচি, এত সংস্কারের পথরেখা—সব চাইছেন। কেউ নির্বাচনের পথরেখা চাইছে, কেউ বিচারের পথরেখা। আমি জিজ্ঞেস করি, আমার অর্থনীতির পথরেখা কোথায়?”—রীতিমতো হতাশার সুরে প্রশ্ন তোলেন দেবপ্রিয়।

তিনি জানান, সরকার তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে: অর্থনীতির ভিত্তিভূমি নির্ধারণ, স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা, এবং সংস্কার বাধা চিহ্নিত করে কার্যকর পদক্ষেপ। কিন্তু বাস্তবে যা ঘটেছে, তা ছিল প্রত্যাশাবিরোধী।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (National Board of Revenue) ও পুঁজিবাজার সংস্কার নিয়ে আলাপ-আলোচনার অভাবকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন তিনি। “শ্বেতপত্রে আমি সুপারিশ করেছিলাম এনবিআরকে দুই ভাগে ভাগ করা হোক—একটি কর আহরণ, অন্যটি করনীতি। এখানে স্বার্থের সংঘাত আছে। অথচ কোনো আলাপ ছাড়াই একটি কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের চেষ্টা হয়েছে—ফলে ফলাফল হয়েছে দুঃখজনক।”

স্টক মার্কেটের দুরবস্থাও তার বিশ্লেষণে উঠে আসে। “এটা আইসিইউতে। আগে জিডিপির ২৭ শতাংশ ছিল, এখন মাত্র ৯ শতাংশ। অথচ যাঁরা স্টক মার্কেটে অংশীদার, তাঁদের সঙ্গে আলোচনা না করে যদি সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন একা কিছু করতে যায়, সফলতা আসবে না।”

তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক সংস্কারের অন্যতম ভিত্তি হল আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত। “যদি সঠিক কাজও হয়, কিন্তু তা সবাইকে না জানিয়ে হয়—তাহলে সেই কাজ বেঠিক হয়ে দাঁড়ায়।”

অন্তর্বর্তী বাজেট নিয়েও প্রশ্ন তোলেন দেবপ্রিয়। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামানকে উদ্দেশ করে বলেন, “আপনারা যে বাজেট করছেন, সেটা একটা পতিত সরকারের বাজেটের কাঠামো। প্রাক্কলন করেছেন, অথচ কাঠামোগত কোনো উন্নয়ন হয়নি। কাকে ছাড় দিচ্ছেন, কোথায় ভর্তুকি দিচ্ছেন, সুদের হার কোথায়—এই স্বচ্ছতার অভাব কাকে বোঝাব?”

তিনি মেগা প্রজেক্টগুলোর অর্থায়ন, অতিমূল্যায়ন এবং উন্নয়ন খাতে সামাজিক সংস্কারের অভাব নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন। “আগের সরকারের এডিপি প্রকল্প এখনো চলছে, অথচ নীতিমালায় কোনো পরিবর্তন নেই। আমি সেই পুরোনো ভিত্তির উপর কাজ করছি, নতুন কিছু দেখছি না।”

অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা থাকলেও, নির্বাচন না হওয়ায় নীতিকাঠামো ও বাজেট বাস্তবায়নে সীমাবদ্ধতা থাকবে বলেও মত দেন তিনি। “এই সরকার পুরো বাজেট বাস্তবায়ন করতে পারবে না। আমরা যদি পরবর্তী সরকারকে ফলো করি, তারা এই বাজেটের ধারাবাহিকতা রাখবে কি না, সেটার কোনো নিশ্চয়তা নেই।”

বিনিয়োগ সম্মেলনের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে বলেন, “সবাই জিজ্ঞেস করেছে, তোমাদের নীতিকাঠামো কোথায়? আমি বলতে পারিনি।” তার মতে, সংস্কার কর্মসূচি যতই হোক, জনগণের অংশগ্রহণ ও স্বচ্ছতা ছাড়া তা ফলপ্রসূ হবে না।

সবশেষে তার হতাশা যেন পুরো দেশের অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়ায়—“২৭ লাখ মানুষ আরও দরিদ্র হয়েছে, অথচ আমরা বৈষম্যবিরোধী উন্নয়ন শেখাতে এসেছি!”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *