নতুন রাজনৈতিক দলের প্রভাব ও অন্তঃকলহে ‘নগদ’, লোপাট অন্তত ১০০ কোটি টাকা

মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস ‘নগদ (Nagad)’ এখন এক ভয়াবহ দুর্নীতি ও ক্ষমতার লড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে। প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরে একাধিক গোষ্ঠী এবং সদ্য প্রতিষ্ঠিত একটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সরাসরি হস্তক্ষেপে ধসে পড়ছে এর অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা। দুর্নীতির মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, গত দুই মাসেই প্রতিষ্ঠান থেকে অন্তত দেড়শ’ কোটি টাকা তুলে নেয়া হয়েছে ভুয়া বিল ও তথ্য গোপনের মাধ্যমে। বাংলাদেশ ব্যাংক এই সংকটে ‘নগদ’-এর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে উদ্যোগ নিলেও আইনি বাধায় তা বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়েছে।

সবচেয়ে ভয়াবহ তথ্য হলো, প্রতিষ্ঠানের সাবেক সিইও তানভীর এ মিশুক (Tanvir A Mishuk) দেশ ছেড়ে পালালেও এখনও বিদেশ থেকে ‘নগদ’-এর যাবতীয় নিয়ন্ত্রণ নিজ হাতে রাখছেন। অভিযোগ উঠেছে, তিনি ইমেইলের মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রুপকে নির্দেশনা দিচ্ছেন, যেখানে পুরনো ডাটাবেস মুছে ফেলার নির্দেশ, ভুয়া ইভেন্ট দেখিয়ে বিল উত্তোলন এবং কর্মী বরখাস্তের মতো সিদ্ধান্তও রয়েছে। এমনকি দেশে না থেকেও এপ্রিল পর্যন্ত মাসিক ১৫ লাখ টাকা বেতন নিয়েছেন তিনি।

ডেপুটি সিইও মুয়ীজ তাসনিম ত্বকি (Muiz Tasnim Taqi) গ্রেপ্তার হওয়ার পর একদিনের মধ্যেই অজ্ঞাত প্রভাবে ডিবি কার্যালয় থেকে মুক্ত হয়ে আবারো দুর্নীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। তিনি নগদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিয়ে জোর করে ভুয়া বিল তৈরি করাচ্ছেন বলে অভিযোগ। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানে অফিস করছেন সাবেক আইসিটি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা আতিক মোর্শেদ (Atik Morshed), যিনি অফিসিয়ালি কোনো পদে না থেকেও সিইও’র চেয়ার পর্যন্ত ব্যবহার করছেন। শুধু তাই নয়, তার স্ত্রীসহ ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দেরও ‘নগদ’-এ নিয়োগ দিয়েছেন তিনি।

তবে পরিস্থিতির সবচেয়ে রহস্যময় দিক হচ্ছে, বর্তমান সিইও মো. সাফায়েত আলম (Md. Safayet Alam) এখনও দেশের মাটিতে পা রাখেননি। ইমেইলের মাধ্যমে দায়িত্ব নেয়ার পর গত ১৫ দিনে তিনি অফিসে না এসেও নগদের অন্তত ১৯ জন শীর্ষ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করেছেন এবং নিজের ঘনিষ্ঠদের পদোন্নতি দিয়েছেন। অর্থাৎ, ‘অদৃশ্য সিইও’ হিসেবেই অফিস চালাচ্ছেন তিনি।

সূত্র বলছে, বরখাস্তকৃত কর্মকর্তারা মূলত বাংলাদেশ ব্যাংক ও কেপিএমজি’র সঙ্গে সহযোগিতা করায় তাদের টার্গেট করা হয়। বিদায় দেয়ার আগে প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ নীতিমালাও ইমেইলের মাধ্যমে পাল্টে ফেলা হয়, যাতে ক্ষতিপূরণ না দিতে হয়।

সবচেয়ে বিতর্কিত ঘটনা হলো, রংপুরের আলোচিত আবু সাঈদ হত্যা মামলার আসামি এবং নগদের চিফ টেকনোলজি অফিসার আবু রায়হানকে প্রায় ৪৫ লাখ টাকার ভুয়া বেতন দেয়া হয়েছে, যদিও তিনি গত আগস্ট থেকে চাকরিতে নেই। এসব অর্থ প্রদান হয়েছে ‘ওয়ান ব্যাংক’-এর একটি অ্যাকাউন্ট থেকে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সরাসরি বলেছে, উচ্চ আদালতের নির্দেশে তাদের নিযুক্ত প্রশাসককে ‘নগদ’ থেকে বের করে দেয়া হয়েছে, এবং সেই ফাঁকেই দুর্নীতির বিস্তার ঘটেছে। নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসাইন খান বলেন, “আমরা শুনে যাচ্ছি, কিন্তু ব্যবস্থা নিতে পারছি না। মিডিয়া ও জনসচেতনতা ছাড়া আমরা এগোতে পারছি না।”

অন্যদিকে আতিক মোর্শেদ নিজের দায় অস্বীকার করে বলেন, “আমি নগদে কোনো চাকরি করি না, ডাক বিভাগ থেকে কিছু বিষয় কো-অর্ডিনেট করছি মাত্র।” ডেপুটি সিইও ত্বকি নিজেও ডাটাবেজ ধ্বংস বা ভুয়া বিলের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

তবে বাস্তব চিত্র বলছে ভিন্ন কথা। একটি রাষ্ট্রীয় সেবাপ্রতিষ্ঠান এখন কিছু ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক স্বার্থের বলি হতে চলেছে। ডিজিটাল লেনদেন নির্ভর সাধারণ মানুষের জন্য এটি উদ্বেগজনক ও বিপজ্জনক সংকেত বয়ে আনছে। সূত্র : মানবজমিন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *