রাষ্ট্রব্যবস্থার আমূল সংস্কারের দাবিতে জাতীয় নাগরিক পার্টি (National Citizens’ Party – NCP) শনিবার একগুচ্ছ প্রস্তাব নিয়ে হাজির হলো জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সামনে। দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল সারাদিনব্যাপী আলোচনায় অংশ নেয়। প্রস্তাবনায় উঠে এসেছে, বর্তমান ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সময়োপযোগী, কাঠামোগত ও সাংবিধানিক সংস্কার কতটা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
প্রতিনিধি দলের দাবিতে স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে, সংসদীয় ব্যবস্থায় ক্ষমতা কাঠামোর ভারসাম্য এবং জবাবদিহিতা ছাড়া কোনো সংস্কারই টেকসই নয়। প্রস্তাবনায় সংবিধান সংশোধনের জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি জানানো হয়েছে। পাশাপাশি এমন বেশ কিছু সংস্কারের প্রস্তাব রাখা হয়েছে, যা দেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ভবিষ্যৎ কাঠামোয় মৌলিক রূপান্তর আনতে পারে।
প্রস্তাবিত সংস্কার তালিকায় রয়েছে—রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী দুইবারের বেশি দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের মেয়াদ ৪ বছর, সংসদে দ্বিকক্ষ ব্যবস্থা চালু করা এবং উচ্চকক্ষ আনুপাতিক ভোটে নির্বাচিত হওয়া। পাশাপাশি ১০০ নারী সংসদ সদস্যকে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থা ও উচ্চকক্ষে নারীদের জন্য ২৫% এবং নির্দলীয়দের জন্য ৩৩% আসন বরাদ্দের প্রস্তাব এসেছে।
আরও বলা হয়েছে, সংসদের ডেপুটি স্পিকারের পদে একজন বিরোধী দলের প্রতিনিধি থাকতে হবে, প্রধানমন্ত্রী ও দলপ্রধানের পদ আলাদা হতে হবে, সরকার হবে মন্ত্রীপরিষদ-নির্ভর, প্রধানমন্ত্রী-নির্ভর নয়। প্রস্তাবে জাতীয় ন্যায়পাল নিয়োগ বাধ্যতামূলক করার কথাও উল্লেখ করা হয়। এছাড়া, দুর্নীতি দমন কমিশনের সাংবিধানিক স্বীকৃতি এবং বিচারক ও সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব জনসমক্ষে প্রকাশের বিষয়টি বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ এসেছে।
সংবিধানের চার মূলনীতি ও কোনো রাজনৈতিক দলের আদর্শ বাদ দিয়ে, সব জাতি ও নৃগোষ্ঠীর সাংবিধানিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়। ইন্টারনেট প্রাপ্তির অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে ঘোষণার দাবি জানানো হয়। প্রস্তাবনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বলা হয়েছে, ভোটাধিকার বয়স ১৬ বছর নির্ধারণ এবং প্রার্থীতার জন্য বয়সসীমা ২৩ বছর করতে হবে। তবে, এ ক্ষেত্রেই সবচেয়ে আলোচিত ও ব্যতিক্রমী প্রস্তাবটি হলো—প্রার্থীতার জন্য কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত রাখা যাবে না।
এনসিপির মতে, প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত আরোপ করা এক ধরনের বৈষম্যমূলক ধারণা, যা গণতন্ত্রের মূলচেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তারা মনে করেন, নেতৃত্বের যোগ্যতা কেবল শিক্ষাগত ডিগ্রি দিয়ে নির্ধারণ করা উচিত নয় বরং গণবিচারে প্রার্থীর বিশ্বাসযোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও জনসম্পৃক্ততাই গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য হওয়া উচিত।
সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব এনে তারা জানিয়েছে, বিচার বিভাগে রাজনীতিকরণের প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। আইনসভার বিভিন্ন কমিটির সভাপতিত্ব বিরোধী দলের হাতে তুলে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যাতে সংসদে সরকারকে আরও জবাবদিহির মুখে পড়তে হয়।
এনসিপি বলেছে, যেসব প্রস্তাব সংবিধান সংশোধনের সঙ্গে সম্পর্কিত, সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য একটি গণপরিষদ নির্বাচন আয়োজন জরুরি। আর বাকি সংস্কারগুলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধ্যাদেশের মাধ্যমেই কার্যকর করা সম্ভব।
এই আলোচনায় অংশ নেওয়া প্রতিনিধি দলে আরও ছিলেন এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন, দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ, মুখ্য সমন্বয়ক নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন, সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব নাহিদা সারওয়ার নিভা, যুগ্ম আহ্বায়ক ও সংস্কার সমন্বয় কমিটির কো-অর্ডিনেটর সারোয়ার তুষার এবং যুগ্ম আহ্বায়ক ও সংস্কার সমন্বয় কমিটির সদস্য জাবেদ রাসিন।
মূলত, এনসিপির প্রস্তাবনাগুলো বর্তমান শাসনব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক কাঠামোতে রূপান্তরের এক সুসংহত নকশা—যেখানে অংশগ্রহণমূলক ও সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার প্রতিফলিত হয়।