“ইউনুসের পদত্যাগ নয়, ব্যর্থ রাজনৈতিক পরিকল্পনার ভাঙন”

দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং নির্বাচনপূর্ব উত্তেজনার পেছনে গভীর কৌশলগত ব্যর্থতা এবং বিভ্রান্তিকর ন্যারেটিভ তৈরির চেষ্টা চলছে বলে মন্তব্য করেছেন সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক বাতেন মোহাম্মদ (Baten Mohammed)। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া এক দীর্ঘ পোস্টে তিনি বলেছেন, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুস (Muhammad Yunus)-এর পদত্যাগ এখন কোনো পক্ষই চাইছে না, বরং ক্ষমতার অভ্যন্তরীণ এক উচ্চাবিলাষী গোষ্ঠী তাঁকে রাজনৈতিক ফাঁদে ফেলতে চেয়েছিল।

বাতেনের ভাষ্যমতে, সরকার-ঘনিষ্ঠ এই অংশটি এক সময় “মাইনাস টু” ফর্মুলার মোড়কে বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল। এর অংশ হিসেবে তারা বিএনপিকে কখনো “আওয়ামী লীগের ছায়া”, কখনো “ভারতের দালাল” আখ্যা দিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াতে চেয়েছে। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল নির্বাচন দীর্ঘায়িত করে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা। কিন্তু বিএনপি যখন রাজপথে শক্তি দেখিয়েছে, তখন এই পরিকল্পনায় বড় ধাক্কা লেগেছে।

তিনি আরও দাবি করেন, সরকারের সেই অংশ ইসলামপন্থীদের ব্যবহার করে রাজপথে উত্তাপ বাড়াতে চেয়েছিল। “সমকাম, ভারত দখল করে ফেলবে, ধর্ম গেলো”—এই চিরাচরিত ট্যাবলেট দিয়ে সহজে নিয়ন্ত্রণযোগ্য গোষ্ঠীগুলোকে মাঠে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই গোষ্ঠীগুলো আদতে ক্ষমতার রাজনীতিতে কার্যকর কোনো ফ্যাক্টর নয়। তারা কেবল ক্ষমতাসমর্থক গোষ্ঠী হিসেবে থাকে, আদর্শগত লড়াইয়ে তাদের উপস্থিতি দুর্বল।

বিএনপির আন্দোলন যখন তীব্র হয়, তখন এই ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোর নিশ্চুপ থাকা তা প্রমাণ করে দিয়েছে। বরং বরাবরই সরকার ও নতুন দলগুলোর পক্ষ থেকে তাদের আশকারা দেওয়া হলেও, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার সময় তারা পাশে থাকে না। বাতেন বলেন, এই বাস্তবতা “আবারও প্রমাণ হলো”—এই গোষ্ঠীগুলো রাজনৈতিকভাবে অনির্ভরযোগ্য।

অধ্যাপক ইউনুসকে উদ্দেশ্য করে বাতেন বলেন, “যদি এখনো বুঝতে না পারেন, সরকারের ঘনিষ্ঠ অংশ তাঁকে ঘোলা খাওয়াচ্ছে, তাহলে তা সত্যিই দুঃখজনক।” তিনি বলেন, দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে, তার বিপরীতে তৈরি হচ্ছে এক অপ্রয়োজনীয় আদর্শিক সংঘাত। বিএনপি ক্ষমতাপন্থী দল—তারা নৈরাজ্য চায় না, নৈরাজ্য চায় যারা ক্ষমতায় বৈধভাবে যেতে পারবে না।

বিএনপির বিরুদ্ধে “নৈরাজ্য সৃষ্টির” অভিযোগ তুলে সরকার কেবল ব্যর্থতা ঢাকার কৌশল নিয়েছে বলে মনে করেন বাতেন। তাঁর ভাষায়, “এটা এক ধরনের ব্লেম গেম।” বিএনপি অপেক্ষায় আছে, কিন্তু সরকার সেই পথকে বন্ধ করতে পুরোনো রাজনৈতিক অপকৌশল অবলম্বন করছে—যা দুর্বল গণতন্ত্র এবং ইনফর্মাল অর্থনীতিনির্ভর দেশে একেবারে পরিচিত কৌশল।

অধ্যাপক ইউনুসের ইমোশন-ভিত্তিক পদত্যাগের সম্ভাবনা নিয়ে বাতেন বলেন, “রাজনীতির ABC বোঝা ছাড়া এমন সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত নয়।” তিনি মনে করেন, ক্ষমতার ট্রানজিশন সম্পর্কে নিশ্চয়তা না দিয়ে একমাত্র আবেগের উপর নির্ভর করে দেশ চালানো যায় না।

এমন উত্তাল সময়ে সরকারের মধ্যকার উচ্চাবিলাষী অংশ এখন হতাশ বলেও মন্তব্য করেন বাতেন। সরাসরি নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, ছাত্র উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ (Asif Mahmud) সম্ভবত সেই গোষ্ঠীর দ্বারা প্রভাবিত। তার সাম্প্রতিক ফেসবুক পোস্টগুলোতে দেখা যাচ্ছে পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার হতাশা এবং এক ধরনের “আমি-ই একমাত্র গণতন্ত্র রক্ষাকারী” মনের বিকৃতি—যা ফ্যাসিবাদের লক্ষণ। বাতেনের ভাষায়, “হাসিনার মতোই একমাত্র রক্ষাকর্তা হয়ে ওঠার ছায়া দেখা যাচ্ছে আসিফ মাহমুদের মধ্যে।”

তিনি আরও জানান, বিএনপি যাদের পদত্যাগ চেয়েছে—ছাত্র উপদেষ্টা ও খলিলুর রহমান—তাদের নির্বাচন প্রলম্বনের পেছনে ভূমিকা ছিল। যদিও মাহফুজকে তিনি “কোলেটারাল ড্যামেজ” হিসেবে দেখছেন, কারণ সম্ভবত সে নিজে এই রাজনৈতিক খেলায় অংশ নেয়নি, বরং ছাত্র প্রতিনিধি হওয়ার কারণেই তার পদত্যাগ চাওয়া হয়েছে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে বাতেন এই মুহূর্তে উভয় পক্ষকে “ডি-এসকালেশন”-এর পরামর্শ দেন। তার মতে, যদি দেশে নির্বাচন ছাড়া শাসনতান্ত্রিক ভ্যাকুয়াম তৈরি হয়, তাহলে দেশ আরও খারাপের দিকে যাবে—আওয়ামী যুগের চেয়েও খারাপ হতে পারে। দেশের স্বার্থেই ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত স্বার্থকে পাশ কাটিয়ে সম্মিলিতভাবে সামনে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *