যে কারনে সংসদ নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি সুপারিশ করেনি সংস্কার কমিশন

দেশে সংসদ নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক (Proportional Representation – PR) পদ্ধতি চালু হলে স্বাধীনভাবে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ আর থাকবে না বলে মত দিয়েছেন নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের দুই সদস্য অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ (Tofail Ahmed) ও ড. মো. আবদুল আলীম (Dr. Md. Abdul Alim)।

স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিদায়ের শঙ্কা

তাঁরা জানান, সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে ভোট দেওয়া হবে দলকে, ব্যক্তিকে নয়। ফলে নিবন্ধিত দলের বাইরে কেউ প্রার্থী হতে পারবেন না। এই পরিবর্তনের ফলে স্বাধীনভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়া এবং বিজয়ী হওয়ার যে দীর্ঘদিনের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, তা বিলুপ্ত হবে।

নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুসারে, অতীতের নির্বাচনে বহু স্বতন্ত্র প্রার্থী অংশগ্রহণ করেছেন এবং অনেকে জয়লাভও করেছেন। যেমন—প্রথম সংসদে ৫ জন, দ্বিতীয়তে ১৬ জন, তৃতীয়তে ৩২ জন, এবং নবম সংসদে ৪ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচিত হন।

পিআর পদ্ধতির ঝুঁকি ও দুর্বলতা

সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পিআর পদ্ধতির অন্যতম বড় দুর্বলতা হলো সরকারের অস্থিতিশীলতা। অতীতে পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম ও নবম জাতীয় সংসদে যদি এই পদ্ধতি কার্যকর হতো, তাহলে কোনো দল এককভাবে সরকার গঠন করতে পারত না। এতে করে বড় দলগুলো ছোট দলগুলোর কাছে জিম্মি হয়ে পড়ত এবং দেখা দিত ‘টিরানি অব দ্য স্মল মাইনরিটি’ বা ‘ক্ষুদ্র সংখ্যালঘুদের আধিপত্য’। এ ছাড়া সরকার গঠনে ভাঙাগড়ার খেলা প্রকট হয়ে উঠতে পারত। এমনকি সরকার গঠনে লেনদেনের প্রভাবও ঘটতে পারত। এ ছাড়া সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে দলের আধিপত্য বেসামাল পর্যায়ে পৌঁছতে পারে।”

কমিশন ফুটনোটে উদাহরণ দিয়েছে ইসরায়েলের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের। সেখানে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের কারণে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু উগ্র ক্ষুদ্র ধর্মীয় দলের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছিলেন এবং এটি গাজায় চলমান যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার একটি কারণ বলে উল্লেখ করা হয়।

প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়েছে, ‘সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির আরো অনেক দুর্বলতা রয়েছে, যা অংশীজনের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় উঠে এসেছে। মতবিনিময়ের সময় একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষ করা গেছে, অনেক ব্যক্তি ও দল যারা নীতিগতভাবে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির পক্ষে, তাদের অনেকেও বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটির প্রবর্তনের বিপক্ষে। তাদের আশঙ্কা, বর্তমান সময়ে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি গৃহীত হলে বিতাড়িত স্বৈরাচারের পুনর্বাসনের আশঙ্কা দেখা দেবে।’

দলীয় প্রাধান্যের অপব্যবহার ও সম্ভাব্য দুর্নীতি

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এই পদ্ধতিতে সংসদ সদস্য মনোনয়ন দলের প্রধানের হাতে কেন্দ্রীভূত হবে। ফলে জনগণের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ না রেখেও মনোনয়ন পাওয়া যাবে, যার ফলে দলীয় প্রধানের আনুগত্যশীল, ‘পোষা এমপি’ তৈরি হবে।

অভিযোগ রয়েছে, এই প্রক্রিয়ায় প্রার্থীরা মনোনয়নের জন্য টাকা দিয়ে দলের নেতাদের কাছে গিয়ে লবিং করবেন এবং এটি পরিণত হতে পারে ‘নিলামপ্রথায়’। বর্তমানে সংরক্ষিত নারী আসনের ক্ষেত্রে যেভাবে মনোনয়ন দেওয়া হয়, সেটির পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে।

স্থানীয় নেতৃত্ব গঠনের ওপর প্রভাব

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বর্তমান আসনভিত্তিক পদ্ধতিতে স্থানীয় নেতারা জনগণের সঙ্গে মিশে ভোট আদায় করেন, যা স্থানীয় নেতৃত্ব গঠনে সহায়ক। কিন্তু পিআর পদ্ধতিতে এই যোগসূত্র আর থাকবে না। জনগণের প্রতিনিধি না হয়ে সংসদ সদস্যরা হয়ে উঠবেন দলীয় ক্লাবের সদস্য মাত্র।

ছোট দলগুলোর আসন লাভের সম্ভাবনা কম

পিআর পদ্ধতিতে কোনো দলকে সংসদে প্রবেশ করতে হলে ন্যূনতম ৫% ভোট পেতে হবে। কিন্তু দেশের বেশিরভাগ ছোট রাজনৈতিক দলের ভোটপ্রাপ্তির হার ৫%-এর নিচে। ফলে তারা সংসদে প্রবেশের সুযোগ হারাবে।

মিশ্র পদ্ধতির প্রস্তাব

কমিশন বলেছে, বিশ্বজুড়ে এখন অনেক দেশ মিশ্র নির্বাচন পদ্ধতি অনুসরণ করছে—যেখানে কিছু আসনে ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট (FPTP), কিছুতে পিআর পদ্ধতি কার্যকর থাকে। কেউ কেউ সংসদে দ্বিতীয় উচ্চকক্ষ চালুর পক্ষে মত দিয়েছেন, যেখানে পিআর পদ্ধতি প্রয়োগ করা যেতে পারে।

তবে প্রতিবেদন অনুসারে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এ নিয়ে তীব্র মতানৈক্য রয়েছে। ফলে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন (Election Reform Commission) মত দিয়েছে—রাজনৈতিক ঐকমত্য না থাকায় তারা কোনো নির্দিষ্ট সুপারিশ দিচ্ছে না।

এ ছাড়া এই পদ্ধতিতে আরো কিছু মন্দ দিক রয়েছে বলে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। কমিশনের প্রতিবেদনে পিআর পদ্ধতির ভালো ও মন্দ উভয় দিক উল্লেখ করে এ সম্পর্কে কোনো সুপারিশ করা থেকে বিরত থাকাই উত্তম মনে করা হয়েছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *