জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আয়োজনে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় সনদ তৈরির দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা শেষ হয়েছে বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই)। আলোচনার শেষ দিনে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ (Ali Riaz) জানিয়েছেন, টানা ২৩ দিন ধরে চলা এ সংলাপে দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিরা অংশ নেন এবং গুরুত্বপূর্ণ ১৯টি সংস্কার বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়।
এর আগে দুই মাস ধরে প্রথম পর্যায়ে ৩০টির বেশি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দলগত ও জোটগতভাবে আলোচনা হয়, যেখানে কমিশনের পক্ষ থেকে উপস্থাপিত ১৬৬টি সুপারিশ নিয়ে মতবিনিময় হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে যেসব বিষয়ে আগেই ঐকমত্য ছিল, সেগুলো বাদ দিয়ে চূড়ান্ত আলোচনায় মূলত ১৯টি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, এই ১৯টি সংস্কার ইস্যুর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছে। তবে কিছু বিষয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বা ভিন্নমত দলগুলোর পক্ষ থেকে জমা দেওয়া হয়েছে। ভিন্নমতের এই নথিগুলোও জাতীয় সনদের অংশ হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
উল্লেখযোগ্য যে, আলোচিত ১৯টি সংস্কার বিষয়ের মধ্যে রয়েছে—সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ, সংসদীয় কমিটির ক্ষমতা, নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ, জরুরি অবস্থা জারি, প্রধান বিচারপতির নিয়োগ, সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়া, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকা, নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্ম কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক, ন্যায়পাল নিয়োগ, সংসদে নারীর অংশগ্রহণ, উচ্চকক্ষ গঠন ও তার এখতিয়ার, রাষ্ট্রপতির নির্বাচন পদ্ধতি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং মৌলিক অধিকার ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে আলোচনায় অর্থবিল ও আস্থা ভোটের ক্ষেত্রে বিএনপি ভিন্নমত প্রকাশ করেছে। বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ ও সুপ্রিম কোর্টের কাঠামো নিয়ে বিএনপি প্রস্তাব করেছে, উচ্চ আদালতের সঙ্গে পরামর্শক্রমে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত।
প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান নিয়েও বিএনপিসহ কয়েকটি দল নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। অন্যদিকে, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, ১২-দলীয় জোট, এনডিএম, আমজনতার দল এবং বিএনপি মত দিয়েছে—সরকারি কর্ম কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও ন্যায়পাল নিয়োগের ক্ষেত্রে নতুন বিধান সংযোজন না করে বিদ্যমান আইনে সংশোধন করে কার্যকরী করাই উচিত।
উচ্চকক্ষ গঠনের ক্ষেত্রে দুই-তৃতীয়াংশ দল ও জোট একমত হলেও বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল, জাতীয়তান্ত্রিক দল, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ ও আমজনতার দল ভিন্নমত দিয়েছে।
রাষ্ট্রপতির নির্বাচন পদ্ধতিতে অধিকাংশ দল একমত হলেও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এতে আপত্তি জানিয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে গণফোরাম, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল, মার্ক্সবাদী বাসদ, বাংলাদেশ জাসদ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও জেএসডি ভিন্নমত পেশ করে। এদের মধ্যে তিন দলের প্রতিনিধি সভা থেকে ওয়াকআউটও করেন।
নারী প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি ছিল আলোচনার অন্যতম বিতর্কিত ইস্যু। বেশিরভাগ দল জাতীয় সংসদে ধাপে ধাপে নারীর আসন সংখ্যা ১০০-এ উন্নীত করার পক্ষে মত দিলেও, কেউ সরাসরি নির্বাচনের পক্ষে, কেউবা সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির পক্ষে অবস্থান নেয়। বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল সরাসরি ১০০ নারী আসনের প্রস্তাবের বিরোধিতা করে।
কমিশনের সহসভাপতি বলেন, আলোচনা শেষে প্রতিদিনের প্রস্তাবগুলো দলগুলোর কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে। বৃহস্পতিবারের বৈঠকে বেশ কিছু বিষয়ের ওপর চূড়ান্ত আলোচনা হয়েছে এবং আগামী শুক্রবারের মধ্যে বিস্তারিত প্রতিবেদন দলগুলোকে দেওয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, “৩১ জুলাইয়ের মধ্যে আলোচনা শেষ করার যে লক্ষ্য ছিল, আমরা সেটি সফলভাবে অর্জন করেছি। এখন জাতীয় সনদের পূর্ণাঙ্গ খসড়া প্রস্তুত করে দলগুলোর কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজ শুরু করেছি।”
আলোচনার বাস্তবায়নপ্রক্রিয়া নিয়েও অংশগ্রহণকারী দলগুলো মত দিয়েছে এবং কমিশনকে এ বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে। আলী রীয়াজ বলেন, “বাস্তবায়নের জন্য সুস্পষ্ট পথনির্দেশ প্রয়োজন, দলগুলোও সে প্রত্যাশা করছে।”
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এই মুহূর্তে সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। তবে আমরা চেষ্টা করব সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বিস্তারিত জানাতে।”