জামায়াতে ইসলামী (Jamaat-e-Islami)-এর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার (Mia Golam Porwar)-এর সাম্প্রতিক বক্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (National Citizen Party – NCP)। এনসিপির শীর্ষ নেতারা গোলাম পরওয়ারের মন্তব্যকে ‘ঔদ্ধত্যপূর্ণ’ এবং ‘অসৌজন্যমূলক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসান মাহবুব জোবায়ের অবশ্য দাবি করেছেন, গোলাম পরওয়ার কেবল ‘বাই দা বাই’ কিছু কথা বলেছেন এবং কোনো দলের নাম উল্লেখ করেননি।
২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে বাংলাদেশের অভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামী ও সে সময়ের সমন্বয়ক শক্তিগুলোর মধ্যে ছিল একধরনের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক। পরবর্তীকালে সেই সমন্বয়কদের মধ্য থেকেই কয়েকজন ছাত্ররাজনীতিতে শিবিরের নেতৃত্বে উঠে আসেন এবং কিছু বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচনে জয়ও পান। রাজনৈতিক অঙ্গনে তখন অনেকেই বলেছিলেন, শেখ হাসিনাবিরোধী আন্দোলনের অনেক নেতা মূলত জামায়াত বা শিবিরপন্থী ছিলেন।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এনসিপির আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশের পরও দুই দলের মধ্যে সম্পর্ক ছিল মধুর। এনসিপির নেতারা বহুবার বিএনপি-কে ইঙ্গিত করে সমালোচনামূলক মন্তব্য করলেও, জামায়াতকে নিয়ে তারা কখনো সরাসরি নেতিবাচক কিছু বলেননি। এমনকি এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম একসময় বলেছিলেন, “অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েই জামায়াতের কাফফারা হয়ে গেছে”—যা রাজনীতিতে আলোচনার জন্ম দিয়েছিল।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দুই দলের মধ্যে সম্পর্কের সেতুবন্ধে ফাটল ধরেছে নাহিদ ইসলামের একটি ফেসবুক পোস্ট ঘিরে। তিনি লিখেছিলেন, “জামায়াতে ইসলামী পিআর পদ্ধতি নিয়ে যে তথাকথিত আন্দোলন শুরু করেছিল, তা ছিল সুচিন্তিত রাজনৈতিক প্রতারণা।” তার দাবি, ঐ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল অভ্যুত্থান-পরবর্তী রাষ্ট্র ও সংবিধান পুনর্গঠনের মূল ইস্যু থেকে জনগণের মনোযোগ সরিয়ে দেওয়া।
নাহিদের এই মন্তব্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামীও। দলের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, রাজনৈতিক বক্তব্যে শিষ্টাচার বজায় রাখা উচিত। তবে সবচেয়ে বড় আলোচনার জন্ম দেয় সাতক্ষীরায় মিয়া গোলাম পরওয়ারের দেওয়া বক্তব্য।
তিনি বলেন, “একটা দল ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে বলেছে আমরা সংস্কার, অংশীদারির রাজনীতি, দেশ গঠন, অভ্যুত্থানে কোনো ভূমিকা রাখিনি। আরে বাবা, তোমরা নতুন ছাত্রদের দল, রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে পাল্লা দিতে গেলে আরও বহুদূর যেতে হবে। জন্ম নিয়েই বাপের সঙ্গে পাল্লা দিও না।”
গোলাম পরওয়ার আরও বলেন, “ওনারা চান আমরা ওনাদের সমালোচনা করি। কেউ তো ওনাদের নাম নেয় না। জামায়াতের মতো বড় দল যদি আমাদের মুখে তাদের নাম নেয়, সেটাই তো তাদের জন্য অর্জন। আমরা তাদের অত আমলে নিই না।”
তার এই বক্তব্যে এনসিপির নেতাদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। দলের যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “রাজনীতিতে মতপার্থক্য থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু মিয়া গোলাম পরওয়ারের বক্তব্য শুধু অসৌজন্যমূলক নয়, রাজনৈতিক ঔদ্ধত্যেরও পরিচায়ক।” তিনি আরও যোগ করেন, “ওনারা আমাদের বয়সে বাবা-দাদার সমান। তাই তাদের কাছ থেকে আমরা এমন মন্তব্য আশা করিনি।”
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, “মিয়া পরওয়ারের মন্তব্য রাজনৈতিক সৌজন্যতাকে আরো এক ধাপ নিচে নামিয়েছে। রাজনীতিতে কারো বাপ হতে চাওয়ার মানসিকতা এক ধরনের দৃষ্টিভঙ্গিগত সমস্যা। গণ-অভ্যুত্থানই আমাদের সবার বাপ, কারণ এনসিপির জন্ম সেই অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে। তখন সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করেছিল, আর এখন কেউ কেউ সেই নেতৃত্ব নিজের করে নিতে চাইছে—এটা রাজনৈতিক বালখিল্যতা।”
তবে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসান মাহবুব জোবায়ের আবারও দাবি করেন, মিয়া গোলাম পরওয়ারের বক্তব্য ছিল “স্নেহপূর্ণ সতর্কতা।” তার ভাষায়, “তিনি কারো নাম নেননি। আমরা সবাই ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের সহযোদ্ধা এবং দেশ গঠনে একসঙ্গে কাজ করছি। বিষয়টি তেমন কিছু নয়।”
এভাবে পারস্পরিক মন্তব্য ও পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় দুই দলের সম্পর্ক এখন দৃশ্যমান টানাপোড়েনের মুখে পড়েছে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।