জোটে থাকলেও ভোট দলীয় প্রতীকে — নতুন আরপিওতে ছোট দলের নেতাদের কপালে গভীর চিন্তার ভাঁজ

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে অন্তর্বর্তী সরকার অনুমোদন দিয়েছে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ (আরপিও)-এর সংশোধিত খসড়া। নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ও বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে আনা এই পরিবর্তন জোট রাজনীতিতে নতুন এক অস্বস্তির জন্ম দিয়েছে। এবার থেকে জোটে থাকা সত্ত্বেও নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে—এই বিধানই ছোট দলগুলোর নেতাদের কপালে ফেলেছে গভীর চিন্তার ভাঁজ।

রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ২৩ অক্টোবর এক ব্রিফিংয়ে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘জোট থাকলেও দলীয় প্রার্থীদের নিজ নিজ প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে, যাতে ভোটাররা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারেন তিনি কোন দলের প্রার্থী।’ তবে রাজনৈতিক মহলে এই বক্তব্য নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট নেতারা মনে করছেন, এটি ছোট দলের জন্য একরকম রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে।

বাংলাদেশের ৫৪ বছরের নির্বাচনি ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোট রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বড় দলগুলো সাধারণত ছোট দলগুলোর সমর্থনে জোট গঠন করে, আর ছোট দলগুলো সংসদে প্রবেশের জন্য বড় দলের প্রতীকের আশ্রয় নেয়। অতীতে আওয়ামী লীগ-এর ‘নৌকা’ প্রতীকে এমপি হয়েছেন জাতীয় পার্টির (জেপি) আনোয়ার হোসেন মনজু, ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন, জাসদের রেজাউল করিম তানসেন, হাসানুল হক ইনু, ফজলে হোসেন বাদশা, তরিকত ফেডারেশনের নজিবুল বশর মাইজভান্ডারি, কল্যাণ পার্টির মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমসহ অনেক হেভিওয়েট রাজনীতিক। একইভাবে বিএনপি-র ‘ধানের শীষ’ প্রতীকে নির্বাচিত হয়েছেন ইসলামী ঐক্যজোটের মুফতি ফজলুল হক আমিনী, মাওলানা আবদুল হালিম, মাওলানা আবদুল মালেক, জাতীয় পার্টির আন্দালিভ রহমান পার্থ ও গণফোরামের নেতারা।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি মাওলানা আবদুল হালিম বলেন, ‘রাজনৈতিক দল মানেই দল—ছোট বা বড় নয়। নিজেদের প্রতীকে নির্বাচন করলে দলের সক্ষমতা ও পরিচিতি বাড়বে।’ তিনি আরও বলেন, ‘জোটের ভেতর থেকেও প্রার্থীদের জেতাতে পারস্পরিক সহযোগিতা করা সম্ভব।’

অন্যদিকে, এনপিপি চেয়ারম্যান ও ১১ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ফরিদুজ্জামান ফরহাদ এই সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘প্রতীক ব্যবহার করতে না পারলে জোটের প্রয়োজন কী? তাহলে জোট প্রথাই বন্ধ করে দেওয়া হোক।’ তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘বিএনপি যদি তাদের প্রতীক অন্য দলকে দেয়, তাতে সমস্যা কোথায়? এর আগে বহু নির্বাচনে এমনটা হয়েছে।’

নিবন্ধনবিহীন দলগুলোর অবস্থাও এখন অনিশ্চিত। ‘বাংলাদেশ জাতীয় দল’-এর চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, ‘আমার দলের নিজস্ব মার্কা নেই। তাই আমাদের প্রার্থীরা ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করবে।’ তিনি মনে করেন, আরপিও সংশোধন এখনই আনা রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, যা ছোট দলগুলোর স্বাধীন রাজনৈতিক অবস্থানকে সংকুচিত করবে।

এদিকে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট রফিক সিকদার ভিন্নমত পোষণ করে বলেন, ‘নিবন্ধিত দলগুলোর নিজ প্রতীকে নির্বাচন করলে কোনো ক্ষতি হবে না, বরং দলের পরিচিতি বাড়বে।’
২০০৮ সালে বিএনপির প্রতীকে নির্বাচিত আন্দালিভ রহমান পার্থ এবারের সংশোধনী নিয়ে বলেন, ‘এটি রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত ছিল। জোটের মধ্যে থেকে প্রতীকের সিদ্ধান্ত তারাই নেবে।’

তবে আরপিও সংশোধনীর এই অংশের পরিবর্তন চেয়ে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) আগামীকাল রোববার চিঠি দেবে বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ এ তথ্য জানিয়েছেন।

আবার নাগরিক ঐক্যের আহবায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলছেন, পরিবর্তনটা কেন আনা হয়েছে সেই ব্যাখ্যা তারা পাননি। “জোটের প্রতীকে ভোট করলে সুবিধা হয়। আবার নিজের আইডেন্টিটি তৈরি করতে অসুবিধা। দুটো দিকই আছে। আমরা আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবো।

সম্প্রতি নিবন্ধন পাওয়া বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান মনে করেন, ‘নিজেদের প্রতীকে নির্বাচন করা ছোট দলগুলোর জন্য ইতিবাচক হতে পারে। তবে বড় দলের সঙ্গে জোটে থাকলে তাদের সমর্থন পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত না নিয়ে আরপিও সংশোধন করলে তা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।’ তার মতে, নির্বাচন কমিশনের দ্রুত সব দলের সঙ্গে আলোচনায় বসা উচিত।

একটি নিবন্ধিত ছোট দলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নেতা মন্তব্য করেন, ‘এই সিদ্ধান্তে অনেক বড় নেতা বিপাকে পড়বেন। কারণ নিজ প্রতীকে নির্বাচন করলে পরাজয়ের ঝুঁকি বেড়ে যাবে।’ তার মতে, নতুন আরপিও সংশোধনী রাজনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনা না করেই গৃহীত হয়েছে।

সবমিলিয়ে, নতুন আরপিও সংশোধনী রাজনৈতিক অঙ্গনে তৈরি করেছে নতুন হিসাব-নিকাশ। বড় দলগুলোর জন্য এটি হয়তো প্রতীকের স্বকীয়তা রক্ষার উদ্যোগ, কিন্তু ছোট দলগুলোর জন্য তা হয়ে উঠেছে এক নতুন দুশ্চিন্তার কারণ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *