কলকাতার ‘রোজডেল গার্ডেন’ এখন আওয়ামী লীগের নতুন সদর দপ্তর!!

দেশজুড়ে অগ্নিগর্ভ রাজনৈতিক বাস্তবতায় পতনের পর কলকাতাকে কার্যত নতুন ‘সদর দপ্তর’ বানিয়ে ফেলেছে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। দলীয় নেতৃত্বের একাংশ এখন ভারতের বিভিন্ন শহরে, বিশেষত কলকাতার রোজডেল গার্ডেনে আশ্রয় নিয়ে গড়ে তুলেছেন ছায়া-দপ্তর, চলছে দলে দলে পরিবার নিয়ে সেখানে সংসার গড়া, রাজনৈতিক পরিকল্পনার আঁতুড়ঘর হিসেবে ওই ভবনের ব্যবহার—সব মিলিয়ে এক চাঞ্চল্যকর রাজনৈতিক বাস্তবতার চিত্র উঠে এসেছে।

রোজডেল গার্ডেনেই চলছে ‘অস্থায়ী দলীয় কার্যালয়’

নিউটাউনের অভিজাত আবাসিক কমপ্লেক্স ‘রোজডেল গার্ডেন’-এর ১১-সি ফ্ল্যাট এখন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ঠিকানা। পরিবারের সঙ্গে এখানে বসবাস করছেন তিনি। শুধু তাই নয়, ওই ভবনের নিচতলায় আরেকটি ফ্ল্যাটও ভাড়া নিয়েছেন তিনি, যেটি কার্যত আওয়ামী লীগের অস্থায়ী কার্যালয়ে পরিণত হয়েছে। বিকাল ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এই অফিসে বৈঠক করেন কলকাতায় অবস্থানরত সাবেক মন্ত্রী-সাংসদরা।

সূত্রগুলো জানায়, এখান থেকেই বাংলাদেশে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করতে নানা ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা ও সমন্বয় চলছে।

কলকাতায় যাঁরা ‘নতুন জীবন’ শুরু করেছেন

আওয়ামী লীগের অনেক প্রভাবশালী নেতাই এখন কলকাতাকে নিজেদের নতুন বাসস্থান হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
– দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নিউটাউনের এক ফ্ল্যাটে স্ত্রীকে নিয়ে থাকছেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি দলীয় কার্যক্রমে সক্রিয় নন।
– সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক তার স্ত্রী ও মেয়ে নিয়ে সেখানেই সংসার করছেন, মাঝে চিকিৎসার জন্য দিল্লিতেও ছিলেন কিছুদিন।
– যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ দিল্লিতে স্ত্রীর সঙ্গে বাস করছেন, যিনি আগে কানাডায় ছিলেন।
– যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম কলকাতার নিউমার্কেটের কাছে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছেন স্ত্রীকে নিয়ে।
– সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম কামাল হোসেন ও একেএম এনামুল হক শামীম, সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল এবং তার স্ত্রী অপু উকিল বেহালায় বসবাস করছেন।
– মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস এবং সাবেক সাংসদ আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম পরিবারসহ রয়েছেন কলকাতায়।

শুধু কেন্দ্রীয় নেতারাই নন—জেলা পর্যায়ের অনেক সাবেক মেয়র, চেয়ারম্যান, ও আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের নেতারাও পরিবার নিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। সন্তানদের অনেকেই ভর্তি হয়েছে স্থানীয় স্কুল-কলেজে।

ঈদের আনন্দ, অভিজাত জীবন ও ডিজিটাল ষড়যন্ত্র

তথ্য বলছে, ভারতের মাটিতে, বিশেষ করে কলকাতায় আওয়ামী লীগের এই প্রবাসী নেতারা কেবল নিরাপদেই নন—বরং তাঁরা আয়েশি জীবন কাটাচ্ছেন। ঈদ উদযাপন হয়েছে একসঙ্গে, অংশ নিয়েছেন সামাজিক অনুষ্ঠানেও। ফেসবুক, টেলিগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, সিগন্যাল ও মেসেঞ্জারে সক্রিয়ভাবে যোগাযোগ রেখে চলেছে দলটির কলকাতাকেন্দ্রিক এই ছায়া কাঠামো।

দলীয় কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি তাদের মূল লক্ষ্য বলে ধরা হচ্ছে—বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল রাখা, বিচারিক প্রক্রিয়া ও নির্বাচনী পরিবেশ ভণ্ডুল করা, এবং শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে চলমান আইনি কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করা।

শেখ হাসিনার কলকাতামুখী পলায়ন ও রোজডেল গার্ডেনের তাৎপর্য

গত বছরের ৫ আগস্ট গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতা হারানোর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। তার পিছু পিছু একে একে কলকাতা ও দিল্লিতে পৌঁছান মন্ত্রী-এমপি ও দলীয় নেতারা। কলকাতার রাজারহাট, নিউটাউন, পার্কস্ট্রিট, সল্টলেক, বেহালা, যাদবপুর, বালিগঞ্জ—এমন বহু এলাকায় এখন ‘আওয়ামী লীগ নেতাদের ঠিকানা’ হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে।

রোজডেল গার্ডেন নিয়ে এক প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, “১৯৪৯ সালে ঢাকার টিকাটুলির রোজ গার্ডেনে যে দলটির জন্ম, সেই দলটি আজ টিকে থাকার লড়াই করছে কলকাতার রোজডেল গার্ডেন থেকে।” তার এই বক্তব্য যেন দলটির বর্তমান বাস্তবতার এক নির্মম প্রতিচ্ছবি।

নিরাপত্তা হুমকি ও গোপন অর্থবিনিয়োগ

নেতারা শুধু রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র নয়, দেশের অভ্যন্তরে অস্থিরতা তৈরির জন্য সন্ত্রাসী, কিলার, মাদক ব্যবসায়ী ও সীমান্তবর্তী চোরাকারবারিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। নিষিদ্ধ সর্বহারা পার্টি ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্থিরতা তৈরির পেছনেও এই প্রবাসী গোষ্ঠীর হাত রয়েছে বলে গোয়েন্দা তথ্যের বরাত দিয়ে জানিয়েছে সূত্রগুলো।

সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্য হলো—এসব কার্যক্রম বাস্তবায়নে তারা ব্যবহার করছে গত ১৫ বছরে গোপনে উপার্জিত বিপুল পরিমাণ অর্থ।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয়, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের পাশাপাশি অবসরপ্রাপ্ত সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তা, চিকিৎসক, আইনজীবী এমনকি সাংবাদিকেরাও রয়েছেন এই প্রবাসী নেটওয়ার্কে।

এই বাস্তবতা নতুন এক রাজনৈতিক অভিঘাত তৈরি করেছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে—যেখানে এক সময়ের সর্বময় ক্ষমতাধর দল আজ দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে কলকাতার কোনো বহুতল ভবনে বসে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই করছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *